১৯৭১ এর ২৪শে মার্চ রাতেই ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম কার্যত বিদ্রোহ শুরু করেন।
রহস্যজনক কারণে চট্টগ্রামের অন্যান্য সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে আগত ক্যাপ্টেন রফিকের অধীনস্থ ইপিআর সৈনিকদের মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামে ক্যাপ্টেন রফিকের বাহিনীর সাথে যোগদানে বাধা দেন।
রফিকুল ইসলাম (বীর উত্তম)
জন্ম ও শিক্ষাজীবন
রফিকুল ইসলাম ১৯৪৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বরে
চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি থানার নাওড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করে। তার বাবার নাম আশরাফ উল্লাহ
এবং মায়ের নাম রহিমা বেগম। তিন ভাই ছয় বোনের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবার বড়। বাবার চাকুরীসূত্রে
শৈশবকাল থেকেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যেয়ে থাকতে হয়েছে যার ফলে পড়াশুনা করতে হয়
ভিন্ন ভিন্ন কয়েকটা স্কুলে।
নিজ গ্রাম নাওড়াতেই প্রাথমিক স্কুলে হাতেখড়ি। পরে
লেখাপড়া করেন পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুরের পালং, কুমিল্লার চান্দিনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ১৯৫৯ সালে অন্নদা
মডেল হাই স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করেন। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট
পাশ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৮১ সালে তিনি আমেরিকার
হার্ভাড বিজনেস স্কুলে সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম কোর্স সম্পন্ন করেন।
কর্মজীবন
বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াকালীন সময়েই
রফিকুল ইসলাম সরাসরি জড়িত হয়ে পড়েন ছাত্র আন্দোলনে। আগ্রহ ছিল সাংবাদিকতার প্রতি।
সেকারণেই ছাত্রাবস্থাতেই কাজ শুরু করেন 'ইউপিপি' সংবাদ সংস্থায়। ১৯৬৩ সালেই যোগ দেন
পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। পাকিস্তানের কাকুল মিলিটারী একাডেমী থেকে প্রশিক্ষণ লাভের
পর ১৯৬৫ সালে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে কমিশন পান। পরে তাকে আর্টিলারী কোরে নেয়া
হয়।
১৯৬৮ সালে লাহোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে
তাকে বদলি করে দেয়া হয় পূর্ব পাকিস্তানে। তিনি নিজ রেজিমেন্টসহ যশোর ক্যান্টনমেন্টে
রেজিমেন্টের অ্যাডজুট্যান্ট হিসাবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। কিছুদিন পর তাকে ডেপুটেশনে
বদলি করা হয় দিনাজপুরে ইপিআর এর ৮ নং উইংয়ের অ্যাসিসটেন্ট উইং কমান্ডার পদে। সেখান
থেকে ১৯৭০ সালের প্রথম দিকে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস্-এর চট্টগ্রাম সেক্টর হেডকোয়ার্টারে
অ্যাডজুট্যান্ট পদে পোষ্টিং দেয়া হয়।
সেনাবাহিনী থেকে ১৯৭২ সালের ২৯ এপ্রিল
অব্যাহতি পাওয়ার পর কিছুকাল তিনি চট্রগ্রামে সে সময়কার বহুল প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক
'দি পিপলস ভিউ’-র সহযোগী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। 'ঢাকা ওয়াসা 'র চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পেয়ে ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৮১ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত
তিনি সেখানে কর্মরত ছিলেন। তারপর হ্যান্ডলুম বোর্ড -এর চেয়ারম্যান এবং সর্বশেষ বি.আই.
ডব্লিউ. টি.সি-এর চেয়ারম্যান হিসেবে ১৯৯০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে অবদান
১৯৭১ সালে রফিকুল ইসলাম পাকিস্তান
সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন পদে চট্টগ্রামে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এ অ্যাডজুট্যান্ট হিসেবে
প্রেষণে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে
সেনা মোতায়েন পরিস্থিতি দেখে এবং দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে তিনি স্বাধীনতার
প্রয়োজনে বিদ্রোহ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং তদনুযায়ী প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। তিনি তার
অধীনস্থ বাঙালি অফিসার ও সিপাহিদের সাথে আলোচনা করে কর্তব্য স্থির করেন, এবং সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালি অফিসারদের সাথে গোপন বৈঠক করে
প্রয়োজনে বিদ্রোহের জন্যে উদ্বুদ্ধ করেন।
১৯৭১ এর ২৪শে মার্চ রাতেই ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম কার্যত বিদ্রোহ শুরু করেন। তার
আদেশ পেয়ে সীমান্ত ফাঁড়িতে বাঙালি সৈন্যরা অবাঙালি সিপাহিদের নিরস্ত্র ও নিষ্ক্রিয়
করে চট্টগ্রামে এসে প্রতিরোধ যুদ্ধে যোগদানের জন্যে প্রস্তুত হয়। এম. আর. চৌধুরী ও
মেজর জিয়াউর রহমানের অনুরোধে সেদিন রফিকুল ইসলাম তাদের চট্টগ্রামে আসার নির্দেশ বাতিল
করেন। কিন্তু পরদিন ২৫শে মার্চ ১৯৭১ তারিখে সংঘর্ষ প্রায় অনিবার্য অনুধাবন করে ক্যাপ্টেন
রফিক সক্রিয় বিদ্রোহ শুরু করেন এবং ইপিআরের অবাঙালি সৈন্য ও অফিসারদের জীবিত অবস্থায়
বন্দী করে রেলওয়ে হিলে তার হেডকোয়ার্টার স্থাপন করেন।
তার অধীনে ন্যস্ত সৈনিকরা এম. ভি.
সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাসের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে লেফটেন্যান্ট
কর্নেল চৌধুরী ও মেজর জিয়াউর রহমান সময়োচিত সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় ২০ বালুচ রেজিমেন্ট-এর
সৈন্যরা চট্টগ্রামে অবস্থিত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার-এর সহস্রাধিক বাঙালি সৈনিক
ও অফিসারকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করে। মেজর জিয়াউর রহমানের অধীনে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল
রেজিমেন্ট এর বাঙালি অফিসার ও সৈনিকরা ক্যান্টনমেন্ট ত্যাগ করে কালুরঘাট ব্রিজের দিকে
অবস্থান নেয়।
কিন্তু রহস্যজনক কারণে চট্টগ্রামের
অন্যান্য সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে আগত ক্যাপ্টেন রফিকের অধীনস্থ ইপিআর সৈনিকদের মেজর
জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামে ক্যাপ্টেন রফিকের বাহিনীর সাথে যোগদানে বাধা দেন এবং ৮ম ইস্ট
বেঙ্গলের সৈনিকদের সাথে কালুরঘাট ব্রিজ এলাকায় অবস্থান নিতে বাধ্য করেন। এ কারণে ক্যাপ্টেন
রফিক সেনাবলের অভাবে চট্টগ্রামে যথাযথ দখল বজায় রাখতে ব্যর্থ হন এবং এক পর্যায়ে পাকিস্তানি
সেনাবাহিনীর প্রচুর ক্ষতি সাধন করে পশ্চাদপসরণ করেন।
পরবর্তীতে ক্যাপ্টেন রফিক তার বাহিনী
নিয়ে চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধ করেন এবং ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে তার হেডকোয়ার্টার
সীমান্তের ওপারে হরিণায় স্থাপন করতে বাধ্য হন। পরবর্তীতে এখান থেকেই তিনি ১ নং সেক্টর
কমান্ডার হিসেবে চট্টগ্রাম এলাকায় যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্বে ন্যস্ত হন।১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে
পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।
রাজনৈতিক জীবন
সামরিক শাসক এরশাদ সরকারের পতন হলে
১৯৯০ সালে দেশের প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারে তিনি মন্ত্রী পদমর্যদায় নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়
এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে তিনি
আওয়ামী লীগে যোগ দেন। এবং চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ শাহরাস্তি নির্বাচনী এলাকা চাঁদপুর-৫
থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারে তিনি
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হাজিগঞ্জ শাহরাস্তি
এলাকা থেকে আবারও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত
জাতীয় সংসদের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪ সালের সাধারণ
নির্বাচনে একই আসন থেকে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়
সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৮ সালে চতুর্থবারের মত একাদশ
জাতীয় সংসদেও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং আবারও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী
কমিটির সভাপতি পদে নির্বাচিত হন।
স্বীকৃতি ও সম্মাননা
বীর উত্তম,বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (২০১৯)
কোন মন্তব্য নেই
please do not enter any spam link in the comment box.