Header Ads



হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি‘র সংক্ষিপ্ত জীবনী।


হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী

হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি‘

কুতুবউদ্দিন আহমেদ ইবনে আবদুল রহিম শাহ ওয়ালিউল্লাহ বলেও পরিচিত ১১১৪ হিজরী সনের ১৪ই শাওয়াল বুধবার দিল্লীতে জন্মগ্রহণ করেন।শাহ ওয়ালিউল্লাহ  ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের একজন ইসলামি পন্ডিত, সংস্কারক এবং আধুনিক ইসলামি চিন্তার একজন প্রতিষ্ঠাতা। সাম্প্রতিক পরিবর্তনের আলোকে তিনি ইসলামি আদর্শকে বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিলেন।
শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর চার বছর পূর্বে ১৭০৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার বংশলতিকা উমর ইবনুল খাত্তাবের পরিবার পর্যন্ত পৌছায়। দিল্লিতে তার পিতা শাহ আবদুল রহিম কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায় তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও আধ্যাত্মিক দিকনির্দেশনা লাভ করেন। কুরআনের পাশাপাশি তিনি আরবি ও ফারসি ব্যাকরণ, সাহিত্য এবং উচ্চস্তরের দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, অধিবিদ্যা, অতীন্দ্রিয়তা ও আইনশাস্ত্রের উপর পাঠ নেন। ১৫ বছর বয়সে তিনি এখান থেকে উত্তীর্ণ হন। একই বছর তার পিতা তাকে নকশবন্দিয়া তরিকায় পদার্পণ ঘটান। মাদ্রাসায়ে রহিমিয়াতে তিনি তার পিতার মৃত্যুর অধীনে শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৭১৮ সালের শেষের দিকে পিতার মৃত্যুর পর তিনি মাদ্রাসার প্রধান হন এবং বার বছর যাবত শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান করেন। এসময় তিনি তার নিজস্ব পড়াশোনা চালিয়ে যান। শিক্ষক হিসেবে তার সম্মান বৃদ্ধি পায় এবং শিক্ষার্থীরা তার প্রতি আকৃষ্ট হয়।
শিক্ষাকাল
ছোট বেলার আচার আচরণেই তার মাঝে ভবিষ্যত মাহাত্নের আভাস পাওয়া যায়। জযবে লতীফ নামক কিতাবে তিনি নিজেই বর্ণনা করেন যে, যখন আমার পাচ বছর বয়স, তখনই আমাকে মক্তবে ভর্তি করে দেওয়া হয়, যখন আমার বয়স সাত হয়, তখন আমার পিতা আমাকে নামায পড়ার আদেশ দেন। আর এই সময়েই আমি হিফজ শেষ করি এবং পনের বছর বয়সেই আমি তাফসীর, হাদীস, ফিকাহ,উসুলে ফিকাহ, তর্কশাস্ত্র, কালাম, চিকিৎসা বিজ্ঞান, জ্যামিতি ইত্যাদি বিষয়ে পূর্ণ জ্ঞান অর্জন করি।
মাত্র তিন বছর বয়সে শাহ ওয়ালিউল্লাহ নাহু ছরফে এমন দক্ষতা অর্জন করেন যে, উক্ত বিষয়ের বিশেষজ্ঞগণ পর্যন্ত তার সামনে এসে মাথা নত করতে বাধ্য হতেন। লোগাত, বালাগাত, ফেকাহ, হাদীস, তফসীর, তাসাওফ, আকায়েদ, মান্তেক, চিকিৎসা শাস্ত্র, দর্শন, অংক, জ্যোতির্বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ক কিতাব তার পিতা শাহ আঃ রহীম সাহেব (রাঃ) এর কাছে পড়েন। মাত্র পনের বছর বয়সে এই সমস্ত বিষয়ের উপর তিনি পান্ডিত্য অর্জন করেন। পুঁথিগত সকল বিদ্যা সমাপ্ত করে তিনি তার পিতার হাতে আধ্যাত্মিক জ্ঞানার্জনের জন্য বাইয়াত হন। তিনি অধ্যাত্ম চর্চার ক্ষেত্রে এরূপ অর্জন করেন যে অল্প সময়ের মধ্যে তিনি এই জগতেও যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেন। আধ্যাত্মিক তালীম শেষ হলে তার পিতা তার মাথায় দস্তারে ফজিলত বেঁধে দেন এবং তাকে সুলুকের তালীমদানের অনুমতি প্রদান করেন। শাহ ওয়ালিউল্লাহ কে তার পিতা চৌদ্দ বছর বয়সে সুন্নাতে শা’দীর কাজ সম্পন্ন করান।
শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রা) ছিলেন ভারতবর্ষের জ্ঞানের জগতের শ্রেষ্ঠ নক্ষত্র। শুধু তাই নয়, তিনি ছিলেন জ্ঞান পিপাষুদের তৃষ্ণা নিবারণের হাউজে কাউসার। আল্লাহতায়ালা পাক-ভারত উপমহাদেশে হাদিস ও সুন্নাতে রাসুল এর প্রভাব, প্রসার ও উন্নতি শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রাঃ) ও তার সন্তান-সন্তুতি শিষ্য, সাগরেদদের দ্বারা ঘটিয়েছেন। ভারতবর্ষে হাদিসের সনদ শাহ সাহেবের উপর নির্ভরশীল।
জ্ঞানের প্রতি শাখায় রয়েছে তার লিখনী, বিশেষ করে হাদীস তফসীর উভয় শাস্ত্রের মূলনীতির উপরে তার লিখনীই যুগ শ্রেষ্ঠ।
শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিস রহ. বর্ণনা করেন যে, তৎকালীন যুগের শিক্ষিত ব্যক্তিরা  আত্নকেন্দ্রিকতার রোগে আক্রান্ত হয়েছিল। তারা কখনো কোন প্রকার জটিল সমস্যার সম্মুখীন হলে কেউ কারো সাথে কোন প্রকার আলাপ আলোচনার প্রয়োজন মনে করতো না। বরং ছোট বড় সকলেই নিজ নিজ ধারণা অনুযায়ী শরীয়ত সংক্রান্ত বিষয়ে কোন একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতো। ফলে এ অবস্থার প্রেক্ষিতে তাকে উপযুক্ত তিনটি বিষয়ের প্রতি মনোনিবেশ করতে হয়েছে। বার বছর যাবৎ আলোচনা, পর্যালোচনা ও গবেষণার পর সংস্কার দ্বারা তার বিপ্লবী আন্দোলনের কর্মসূচী হিসেবে গ্রহণ করেন এবং এব্যাপারে তিনি মৌলিকভাবে দুটি বিষয়ের প্রতি অধিক গ্ররুত্বারোপ করেন।
প্রকৃতপক্ষে শুধুমাত্র সংস্থার আন্দোলন দ্বারা কোন দেশের মানুষের আত্নশুদ্ধি করা অত্যান্ত কঠিন ব্যপার । এর জন্য প্রয়োজন আম্বিয়ায়ে কেরামের সংস্কার ধারা ঠিক রেখে দ্বীনের পরিপূর্ণ জাগরণ সৃষ্টি করা। তৎকালীন সম্রাট আকবরের প্রবর্তিত দ্বীনে এলাহীর উদার নীতির ফলে মুসলমানদের ঈমান-আকীদার ক্ষেত্রে যে বিশৃঙ্ক্ষলা বিরাজ করছিল তা সকলেরই জানা। সহজ-সরল মুসলিম জাতি বিভিন্ন ভাবধারা ও দর্শনপন্থিদের সাথে উঠা-বসা, চলা-ফেরার কারণে, বিশেষ করে সম্রাট আকবরের আমলে হিন্দু সাংস্কৃতির একক প্রাধান্যতার কারণে ভারতবর্ষে শুধুমাত্র নামধারী মুসলমানেরই অস্তিত্ত্ব বাকি ছিল। ইসলামী ধ্যান-ধারনা, ইসলামী আকীদা, ইসলামী অনুশাষনের সাথে তাদের পার্থক্য ছিল আকাশ পাতালের ন্যায়।

শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিস রহ. এ সত্যকে উপলব্দি করতে পেরে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, এ বিপর্যয় থেকে মুসলিম জাতীকে উদ্ধার করতে হলে ব্যাপকভাবে কুরআনের দাওয়াত প্রচার করতে হবে। মহাগ্রন্থ আল কুরআন সার্বজনিন ও আন্তর্জাতিক। যে কোন যুগে যে কোন স্থানে এর বৈপ্লবিক নীতিকে অনুসরণ করলে ইসলামের স্বর্ণ যুগের (সাহাবাদের যুগের) ন্যায় নব জাগরণের সূচনা ঘটবে। এ কাজকে তিনি আঞ্জাম দিতে সর্বপ্রথম তিনি ফার্সী ভাষায় কুরআনের অনুবাদ করেন যার নাম করন করেন, “ফুতুহুর রহমান” করে। এ কাজ করতে গিয়ে তাকে অনেক গাল মন্দ ও বিপদের সম্মক্ষিণ হতে হয়েছে। এক দল আলেম তো বলেই ফেলেছে যে, ফার্সী ভাষায় কুরআনের অনুবাদ করলে কুরআনের অলৌকিকত্ত্ব ও তার মাধুর্যতা নষ্ট হয়ে যাবে। সুতরাং এ রকম কাজ করা কুফুরী তুল্য। শুধু এতটুকুনই নয় বরং এক পর্যায়ে তার ব্যাপারে কুফুরীর ফতোয়া ও দেয়া হয়। কিন্তু এ কথা চিরন্তন সত্য যে, “ কুকুরের ঘেউ ঘেউ চন্দ্রের আলোকে ম্লান করতে পারে না। তাই তার অবদান পৃথিবীতে বিরজমান রইল।

এ বিষয়ে আমাদের জানতে হলে প্রথমেই আমাদের জানতে হবে যে, ইসলামের মধ্যে হাদীসের গুরুত্ত্ব কতটুকুন। হাদীসের প্রচার ও তার সংরক্ষণ কেন প্রয়োজন? হাদীস সম্পর্কে অজ্ঞ থাকা বা অবহেলা করলে ক্ষতি কী? প্রকৃতপক্ষে হাদীস হল উম্মতের ঈমান-আকীদার জন্য মান দন্ড সরূপ। শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী রহ. এর প্রথম কর্মসূচী ছিল আল কুরআনের প্রতি দাওয়াত। এই কাজের জন্য হাদীসের জন্য কতটুকুন তা আর আলোচনার অপেক্ষা রাখে না। তার কারণ হল পবিত্র কুরআনের ব্যাখাই যে, হাদীসে নববী । যেমন কুরআনের মাঝে আছে,রাসূলুল্লাহ সাল্ল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মাঝে রয়েছে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ। ভারতের মাঝে যে শিরক-বিদআতের সয়লাব দেখা দিয়েছিল। তার এও একটা কারণ ছিল যে, হাদীসে নববীর প্রতি অবজ্ঞা ও অবহেলা প্রদর্শন করা। রাসূলে কারীম সাল্ল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বর্ণনা করেন, যখন কোন সম্প্রদায় একটি বিদআতে লিপ্ত হয়, তখন তাদের থেকে একটি সুন্নত উঠিয়ে নেয়া হয়। (মিশকাত) শাহ সাহেব সমাজ থেকে শিরক বিদআতের অন্ধকারকে দূর করার লক্ষ্যে সুন্নতে নববীর প্রচার প্রসার মনোযোগি হলেন। মূলত তিনিই প্রথম মানুষ যিনি ভারত উপমহাদেশে সর্ব প্রথম হাদীসের দরস চালু করেন। হাদীসের ক্ষেত্রে হযরত শাহ সাহেবের অনেক অবদান রয়েছে। তার লিখিত হাদীস গ্রন্থসমূহ থেকে উল্লেখযুগ্য কয়েকটি: মুছাফ্ফা, মুছাওয়া, শরহে তরজমায়ে সহীহ বুখারী, আল-ফসলুল মুবীন মিন হাদীসিন নাবিয়্যিল আমীন।

১৭২৪ সালে তিনি হজ্জ পালনের জন্য হেজাজ গমন করেন। তিনি সেখানে আট বছর অবস্থান করেন এবং আবু তাহের বিন ইবরাহিম আল কুর্দি আল মাদানির মত পন্ডিতদের কাছ থেকে হাদিস ও ফিকহ শিক্ষালাভ করেন। এসময় তিনি মুসলিম বিশ্বের সকল প্রান্তের লোকের সংস্পর্শে আসেন এবং বিভিন্ন মুসলিম দেশের অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারেন। এসময় তিনি সাতচল্লিশটি আধ্যাত্মিক বিষয় দেখতে পান যা তার বিখ্যাত রচনা ফুয়ুদ আল হারামাইনের বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ায়।[৬]

১৭৩২ সালে তিনি দিল্লি ফিরে আসেন এবং ১৭৬২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত জীবনের বাকি সময় এখানে অতিবাহিত করেন ও লেখালেখি চালিয়ে যান। তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল হুজ্জাতুল বালিগা। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, অধিবিদ্যাসহ সম্পূর্ণ ধর্মতাত্ত্বিক বিষয়েও তিনি লিখেছেন। ইসলামের প্রকৃত ও আদিরূপ বিষয়ে তার মত তিনি এসব লেখায় তুলে ধরেন।
১৭৬২ সালের এই দিনে ২০ আগস্ট উপমহাদেশের অবিসংবাদিত শ্রেষ্ঠ আলিম, মুজাদ্দিদে মিল্লাত, ইমামুল হিন্দ শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী রহ. পৃথিবী ছেড়ে চলে যান।

কোন মন্তব্য নেই

please do not enter any spam link in the comment box.

merrymoonmary থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.