Header Ads



মুহাম্মদ আবু আব্দুল্লাহ বুখারী(রহঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী।


মুহাম্মদ আবু আব্দুল্লাহ বুখারী(রহঃ)

পরিচয় : মুহাম্মদ আবু আব্দুল্লাহ বুখারী(রহঃ)

নাম মুহাম্মদ, উপনাম আবু আব্দুল্লাহ, উপাধি আমীরুল মোমেনীন ফীল হাদিস, নাসেরুল আহাদিসিন নাবাবীয়্যাহ্‌ ও নাশেরুল মাওয়ারিছিল মুহাম্মদিয়াহ্‌ । ১৩ই শাওয়াল শুক্রবার, ১৯৪ হিজরীতে (৮১০ খ্রিষ্টাব্দ) খোরাসানের বুখারাতে (বর্তমানে উজবেকিস্তানের অংশ) জন্মগ্রহণ করেন।  তার বাবার নাম ইসমাইল ইবনে ইব্রাহিম। তার দাদার নাম ইব্রাহিম। তার দাদার সম্পর্কে খুব বেশি জানা না গেলেও তার বাবা ইসমাইল মুসলিম বিশ্বে একজন পরিচিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন হাদীসবিদ। তিনি হাদিস শাস্ত্রবিদ আল্লামা হাম্মাদ এবং হযরত ইমাম মালেক এর শাগরিদ ছিলেন। এছাড়াও বিখ্যাত মনীষী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক এর শাগরিদ ছিলেন বলে জানা যায়। সমসাময়িক যুগের আরও অনেক বুজুর্গ আলেমদের কাছ থেকে দ্বীনে ফায়েজের জাহেরি ও বাতেনি ইলম হাসিল করে সুযোগ্য আলেম ও বিজ্ঞ মুহাদ্দিস হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।ইমাম বুখারী শিক্ষা, জ্ঞান ও যোগ্যতা শুধু পিতার দিক থেকেই পাননি বরং মাতার দিক থেকেও অর্জন করেছিলেন। ইমাম বুখারী এর মাতা ছিলেন বিদূষী ও মহীয়সী মহিলা। নেককার মহিলা হিসেবে তার পরিচিতি ছিল। এ সম্পর্কে একটা ঘটনা আছে। বাল্যকালে ইমাম বুখারী এর একবার কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। এ রোগের প্রভাবে তার দুই চোখ প্রায় অন্ধ হয়ে যায়। স্নেহময়ই মাতা পুত্রের চোখের আলোর পুনঃপ্রাপ্তির জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েন এবং আল্লাহ্ পাকের দরবারে প্রার্থনা করতে থাকেন। এ পর্যায়ে এক রাত্রে স্বপ্নে তিনি হযরত ইব্রাহীম কে তার শিয়রে বসা অবস্থায় দেখতে পেলেন। হযরত ইব্রাহীম তাকে বলেন, তোমার প্রার্থনা আল্লাহ্ পাক কবুল করেছেন। তার দয়ার বরকতে তোমার পুত্র চোখের আলো ফিরে পেয়েছে। পরদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে তার পুত্র ইমাম বুখারী বলে উঠলেন, আম্ম! আমি সবকিছু দেখতে পাচ্ছি। আমার চোখ ভাল হয়ে গেছে। এ ঘটনাটিই প্রমাণ করে ইমাম বুখারী এর মাতা কত বড় মাপের বুজুর্গ মহিলা ছিলেন।ইমাম বুখারী শৈশবেই বাবাকে হারান, ফলে মায়ের কাছে প্রতিপালিত হন। পিতা মারা যাওয়ার সময় প্রচুর ধনসম্পদ রেখে যান। ফলে ইমাম বুখারী কে কোনরূপ প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়নি। মাতাই পুত্রের শিক্ষা-দীক্ষার ভার গ্রহণ করেন। ইমাম বুখারী এর বাল্যকাল থেকেই শিক্ষা-দীক্ষার প্রতি গভীর আগ্রহ ছিল। ইমাম বুখারী প্রথমে কোরআন পাঠ শুরু করেন। মাত্র ৬ বছর বয়সে তিনি কুরআন মুখস্থ করেন। ১০ বছর বয়স থেকে তিনি হাদীস মুখস্থ করা শুরু করেন। ১৬ বছর বয়সেই তিনি "আবদুল্লাহ বিন মুবারক" এবং "ওয়াকীর পান্ডুলিপিসমূহ" মুখস্থ করে ফেলেন। মহান আল্লাহ্ পাক তাকে অনন্য সাধারণ স্মরণ শক্তি দান করেছিলেন।

ইমাম বুখারী (রহঃ)-এর বাল্যকাল : ঘটনা বর্ণিত আছে যে- ইমাম বুখারী (রহঃ) ছোটবেলায় একবার অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। তখন তার মা কান্না করতে করতে মহান আল্লাহ-তায়ালার কাছে ইমাম বুখারী (রহঃ)-এর আরোগ্য লাভের দোয়া পেশ করতে থাকেন। একদিন রাত্রে মা স্বপ্ন দেখেন হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এসে বলছেন, ‘আল্লাহ্ তায়ালা তোমার দোয়া কবুল করেছেন। আল্লাহর দয়াতে তোমার পুত্র চোখের জ্যোতি ফিরে পেয়েছে।’ রাত্রি পার হয়ে সকালেই ইমাম বুখারী (রহঃ)-এর মা দেখলেন ইমাম বুখারী (রহঃ) তার চোখের আলো আবার ফিরে পেয়েছেন। এই ঘটনা থেকেই বুঝা যায় ইমাম বুখারী (রহঃ)-এর মাতা কেমন মহীয়সী-পরহেজগার নারী ছিলেন। তবে শৈশবেই বাবাকে হারান ইমাম বুখারী (রহঃ) কিন্তু পিতা রেখে যাওয়া অঢেল সম্পদের ফলে কোন রূপ অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার প্রভাব পড়েনি তার উপর। ৯ বছর বয়সেই ইমাম বুখারী (রহঃ) পবিত্র কুরআন হিফজ করেন এবং দশ বছর বয়স থেকেই তিনি হাদিস শিক্ষা শুরু করেন। হাদিস শিক্ষা জীবনে ইমাম বুখারী (রহঃ)-এর জীবনে ঘটে গেছে অনেক তাৎপর্যপূর্ণ ও মজার কিছু ঘটনা।
সাধারণত হাদীসের ক্লাশে সকল ছাত্ররা হাদীসগুলো নোট করে রাখতো, কিন্তু ইমাম বুখারী কোন দিনই নোট করে রাখতেন না। এভাবে ষোল দিন অতিবাহিত হলো। সকল সহপাঠীরা ইমাম বুখারী (রহঃ)-কে প্রতিদিনই বলতে লাগলেন, ‘আপনি কোন হাদীস নোট করে রাখেন না কেন?’ ইমাম বুখারী উত্তর দিলেন- সকলেই আমাকে প্রতিবার একই প্রশ্ন করছে। যে সমস্ত হাদিস আপনারা নোট করেছেন তা আমাকে পড়ে শোনান। সকলেই তা দেখানোর পর তিনি সকল হাদিস ঠোটস্থ শুনিয়ে দিলেন। শুধু তাই নয় আরো পনেরো হাজার হাদীস অতিরিক্ত শুনিয়ে দিলেন। সেদিন থেকেই সহপাঠীরা বুঝতে পারলেন যে, ইমাম বুখারী একজন ব্যতিক্রম-অসাধারণ মুহাদ্দিস। এছাড়াও আরো অনেক ধরনের ঘটনা আছে ইমাম বুখারীর শিক্ষাজীবনে।
শিক্ষা জীবন
ইমাম বুখারী শৈশবেই পিতৃহারা হন । মাতৃক্রোড়ে তিনি লালিত পালিত হন । দশ বৎসর বয়সেই তিনি হাদিস হেফজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন । মাত্র ১৬ বৎসর বয়সেই তিনি হযরত ওয়াকী বিন জাররাহ্‌ (রঃ) ও ইবনে মোবারক (রহঃ) এর হাদিস সঙ্কলন মুখস্ত করেন । তিনি মাতার সঙ্গে হজ্জে গমন করেন । হিজাজে তিনি জ্ঞানার্জন করেন । সেখানে (হেজাজে) ছয় বৎসর অতিবাহিত করে দেশে ফিরেন । অতঃপর তিনি হাদিস শিক্ষা গ্রহন করার জন্য কুফা, বস্রা, বাগদাদ, মিশর ও সিরিয়া প্রভৃতিদেশ ভ্রমন করেন । তার স্বনামধন্য ওস্তাদ বা শায়খগনের মধ্যে মক্কী বিন ইব্রাহীম, আব্দুল্লাহ বিন মুছা, ইসা আবু আসেম, আলী ইবনুল মদিনী, ইশাক বিন রাহওয়াইহ, আহ্মদ বিন হাম্বল, ইয়াহিয়া বিন মুঈন, আবু বকর বিন আবি শায়বা, ওসমান বিন আবি শায়বা ও ইমাম হুমায়দী প্রমুখগনের নাম সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য । এক লক্ষ লোক ইমাম বুখারীর নিকট হাদিসের শিক্ষা গ্রহন করেন । তার শিষ্যগনের মধ্যে ইমাম মুসলিম, ইবনে খোযায়মা, ইমাম তিরমিযী ও ফরবরী প্রমুখের বশেষভাবে উল্লেখযোগ্য

কৃতিত্ব
৩ লক্ষ হাদিস তার সনদ সহ মুখস্ত ছিল । ৬ লক্ষ হাদিস হইতে তিনি তার আল্‌ জামি আস সাহীহ গ্রন্থ সঙ্কলন করেন । ইহাতে তিনি ৭২৭৫ টি হাদিস লিপিবদ্ধ করেন । প্রতিটি হাদীস গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করার পূর্বে তিনি গোসল ও ওযু করিয়া দুই রাক'আত নফল সালাত আদায় করিতেন । সহীহ বুখারী সর্বাপেক্ষা বিসবস্ত হাদীছ গ্রন্থরূপে স্বীকৃত । সহীহ বুখারীর ভূমিকাসরুপ প্রথমবার হজ্জ করিবার সময় মদীনায় অবস্থানকালে তিনি হাদিস বর্নাকারিগনের জীবনী সম্পর্কে 'আত-তারিখুল-কাবীর' নামে একখানা গ্রন্থ প্রনয়ন করেন । এতদব্যতীত নিমনলিখিত গ্রন্থগুলিও তিনি রচনা করেনঃ
১) আল আদাবূল মুফরাদ
২) আত-তারীখুল-আসওয়াদ
৩) আত-তারীখুস-সাগীর
৪) খালকু আফ'আলিল ইবাদ
৫) কিতাবুদ দু'আফা
৬) আল-জামিউল-কাবীর
৭) আল-মুসনাদুল-কাবীর
৮) কিতাবুল-হিবা
৯) আসাসুস সাহাবা
১০) কিতাবুল ইলাল
১২) কিতাবুল বিজদান
১৩) কিতাবুল মাবসুত ইত্যাদি

বুখারী শরীফ ও হাদীস সংগ্রহ : বুখারী শরীফ এর প্রতিটি হাদিসের সংগ্রহ ও প্রমাণের জন্য ইমাম বুখারী (রহঃ)-কে যাত্রা করতে হয়েছে শত সহস্র মাইল। এমন ঘটনাও বর্ণিত আছে যে একটি হাদিস সংগ্রহের জন্য তিনি দুই মাসের রাস্তাও পাড়ি দিয়েছেন। বিভিন্ন দেশে ভ্রমনের মাধ্যমে তিনি লক্ষাধিক সহীহ হাদীস সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি হাদিস সংগ্রহের উদ্দেশ্যে মক্কা, মদিনা, সিরিয়া, হিজাজ, মিশর ও ইরাকসহ আরো অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন। এ সকল দেশ ভ্রমণ করতে গিয়ে তাকে অনেক মুহাদ্দিসদের কাছে পরীক্ষায় পড়তে হয়েছে। এ সকল পরীক্ষায় তিনি সফলভাবে নিজের যোগ্যতার ও দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছেন।
ইমাম বুখারী (রহঃ)-এর শেষ জীবন ঃ ইমাম বুখারীর সুনাম যখন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। তখন ইমাম বুখারী (রহঃ)-কে বুখরার শাসনকর্তা খালিদ বিন আহমাদ যুহলী দরবারে এসে তার সন্তানদেরকে হাদিস শিক্ষাদানের জন্য আহবান জানান। কারণ সাধারণ জনগণের সাথে মসজিদে বসে আমীরের ছেলেদের পক্ষে সহীহ বুখারী পড়া সম্ভব নয়। কিন্তু বয়োঃবৃদ্ধ-জ্ঞানবৃদ্ধ শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ ইমাম বুখারী এটাকে হাদিসের অবমাননা মনে করলেন এবং আমিরের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি জানিয়ে দিলেন যে, তার সন্তানদের যদি হাদিস শিক্ষা দেয়ার ইচ্ছা থাকে তাহলে যেন মসজিদে পাঠিয়ে দেন। খালিদ বিন আহমাদ যুহলী এই প্রত্যাখ্যানকে অপমান হিসেবে নিলেন এবং ইমাম বুখারীকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করলেন। এহেন ষড়যন্ত্রের প্রেক্ষিতে ইমাম বুখারী নিজ জন্মস্থান বুখারা ত্যাগ করে নিশাপুরে হিজরত করলেন। বুখারা ত্যাগ করার সময় ইমাম সাহেব আল্লাহর কাছে এই দুআ করেন যে, ‘হে আল্লাহ্! সে আমাকে যেভাবে অপমান করে বের করে দিলো তুমিও তাকে অনুরূপ লাঞ্ছিত করো।’
এই দোয়ার মাত্র কিছুদিন পরই বুখারার শাসনকর্তা খালিদ বিন আহমাদ যুহলীর বিরুদ্ধে সে দেশের জনগণ বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং আমীরকে ক্ষমতাচ্যুত করে বাগদাদের জেলে প্রেরণ করে দেয়। পরবর্তীতে বাগদাদের জেলেই বুখারার শাসনকর্তা খালিদ বিন আহমাদ যুহলী মৃত্যুবরণ করেন।
নিশাপুরেও ইমাম বুখারি (রহঃ) খুব বেশী দিন থাকতে পারলেন না। অনুরূপ দুঃখজনক ঘটনার প্রেক্ষিতে তিনি সমর কন্দের খরতঙ্গ এ চলে যান এবং সেখানেই ২৫৬ হিজরী, শাওয়ালের এক তারিখ (৩১ আগস্ট ৮৭০ খ্রি.) শুক্রবার ঈদুল ফিতরের রাত্রিতে ইহলোক ত্যাগ করেন। ঈদের দিন জোহরের নামাজের পর তার জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়।
বর্ণিত আছে- দাফনের পর তার কবর থেকে মিসকের সুগন্ধির থেকেও বেশী সুঘ্রাণ বের হতে থাকে। এই অবস্থা লোকেরা তার কবরের মাটি নেয়া শুরু করে এবং এর প্রেক্ষিতে সীসার প্রাচীরের মাধ্যমে ইমার বুখারী (রহঃ)-এর কবরটিকে মজবুতভাবে ঢেকে দেয়া হয়।

কোন মন্তব্য নেই

please do not enter any spam link in the comment box.

merrymoonmary থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.