Header Ads



মহিউদ্দিন চৌধুরী প্রতিষ্ঠা করেন বিজয়স্তম্ভ ও বিজয় টিভি।

 

মহিউদ্দিন চৌধুরী প্রতিষ্ঠা করেন বিজয়স্তম্ভ ও বিজয় টিভি।

১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস,১৫ ডিসেম্বর চট্টগ্রামবাসীর জন্য মহিউদ্দিন দিবস, আর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস। যেন এক সূত্রে গাঁথামালা।

চট্টলবীর আলহাজ্ব এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী ডিসেম্বরের ১ তারিখ জন্ম এবং ১৫ ডিসেম্বর মৃত্যু বরণ করেন। ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস, ১৫ ডিসেম্বর চট্টগ্রামবাসীর জন্য মহিউদ্দিন দিবস, আর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস। যেন এক সূত্রে গাঁথামালা। বাঙালির বিজয়ের কারণে ‘বিজয়’ শব্দটির প্রতি ছিল তাঁর প্রচণ্ড অনুরাগ। তাই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বিজয়স্তম্ভ ও বিজয় টিভি। বিজয়-১৬ নামে একটি পত্রিকার ডিক্লারেশনও তিনি নিয়ে রেখেছিলেন। মহান আল্লাহ পাক বিজয়ের মাসে তাঁর জন্ম ও মৃত্যু ভাগ্যে নির্ধারণ করেছেন।

মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রবিউল আউয়াল মাসে দুনিয়াতে শুভাগমন করেন করেন এবং এই মাসে দুনিয়া হতে বিদায় নেন। জননেতা আলহাজ্ব এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী চন্দ্রবর্ষের কোন মাসে জন্ম গ্রহণ করেছে তা আমাদের জানা নেই কিন্তু পবিত্র রবিউল আউয়াল মাসের শুক্রবার রাতে তিনি ইন্তেকাল করেন। প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুক্রবারের মৃত্যুকে মর্যাদাবান এবং এইদিনের রাতের মৃত্যু আরো বেশী মর্যাবান বলে ঘোষণা করেছেন। এসব কারণে আমাদের আত্মস্থ হয় যে, তাকে মহান আল্লাহ পাক কবুল করেছেন। অলিকুল সম্রাট আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)নাম ‘মহিউদ্দিন’। তাঁর নামের বরকত গ্রহণের জন্য পরিবার নাম রাখেন মহিউদ্দিন। মহিউদ্দিন চৌধুরী বলতেন, আমার জন্য চিন্তা করো না, কারণ মহান আল্লাহ পাক কেয়ামতের ময়দানে জান্নাতে যাওয়ার জন্য যখন আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)কে মহিউদ্দিন নামে ডাকবেন তখন আমি মহিউদ্দিন তাঁর নামের বরকতে এক সাথে জান্নাতে ঢুকে যাবো। মহান আল্লাহ তাঁর ইচ্ছা পূর্ণ করুক।

ভারতে প্রথম প্রধানমন্ত্রী জাওহের লাল নেহেরু বলতেন, দুই ধরনের নেতা আছে, লিডার অব পার্টি আর লিডার অব পিপলস। মহিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন প্রকৃত একজন জননেতা। তাঁর সাথে কোন অফিসার বাসায় দেখা করতে পারবে কি না জানতে চাইলে মহিউদ্দিন ভাই বলতেন, আমি রাজনীতিবিদ আমার বাসায় কুত্তা নেই, দারোয়ান নেই, আপনি এসে ঢুকে ঘরে বসে যেতে পারবেন। আমরা তাঁর বেড রুম পর্যন্ত চলে যেতে পারতাম। প্রকৃত রাজনীতিকের বাড়ীতে কুত্তাও থাকে না, দারোয়ানও থাকে না, তাদের পকেটের টাকা জনগণের।

মহিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন একজন প্রকৃত চট্টল বন্ধু। মন্ত্রী এম পি বড় বড় নেতা যেমন তাঁর বন্ধু ছিলেন তেমনি রাস্তার ভিক্ষুকও ছিল তাঁর বন্ধু। গরীব উল্লাহ মাজার হতে নামার সময় হাত পা নেই এমন ভিক্ষুকগণ বলতেন, ‘চদরী সাব আজিয়া টেয়াঁ ন দিবেন ? বন্ধুর মত এ ধরনের অনেক কথা ভিক্ষুকগণ বলতেন। অধিকাংশ সময় তাদের তিনি টাকা দিতেন, আবার কোন কোন সময় বলতেন, দুর বেডা আজিয়া টেয়াঁ ন আনি’। ঈদের সময় রাস্তায় ভিক্ষুককে ধরে বাসায় এনে নতুন কাপড় পরিয়ে আনন্দিত হতেন।

আহমদদা এক সময় হোটেলের গ্লাসবয় ছিলেন। মহিউদ্দিন ভাই প্রথম পর্যায়ে শ্রমিক আন্দোলন আহমদদাদের নিয়ে শুরু করেন। মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর আহমদদার দুই ছেলেকে ড্রাইবার হিসেবে চাকুরীদেন এবং সবজি বিক্রয়ের জন্য আহমদদাকে একটি ঠেলা গাড়ী প্রদান করেন। তাঁকে মহিউদ্দিন চৌধুরী সারাজীবন বন্ধু হিসেবে পরিচয় দিতেন। আমি আহমদদার সাথে দুষ্টুমি করলে তিনি বলতেন, ইতা তোঁয়ার বন্ধু ন তো, আঁর বন্ধু। ইতাল্লয় দুষ্টামি ন গজ্জু। আহমদদাদের তিনি বন্ধু পরিচয় দিতেন গর্বের সাথে। তিনি বস্তির সুইপারের সাথে খিচুড়ী খেতেন, অথচ মনে কোন সংশয় ছিল না তাঁর।

মহিউদ্দিন চৌধুরী কোন ব্যক্তির নাম নয়, তিনি ছিলেন বড় মাপের এক প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান হতে অনেক কিছু শিখার আছে। তাঁর রাজনীতি কমিটম্যান্টের ছিল। জীবন বিসর্জন দিতে পারেন, কিন্তু আদর্শ ত্যাগ করা যাবে না, এই হলো তাঁর রাজনৈতিক শিক্ষা। সব সময় মুজিব কোট পরতেন, এটি তাঁর বাইরের পোশাক নয়, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অন্তরে প্রচণ্ডভাবে ধারণ করতেন। ক্ষমতা নয়, আদর্শ বড় মনে করতেন বলেই তিনি মাতৃভূমি ত্যাগ করেছেন, কলকাতার রাস্তায় পত্রিকা বিক্রয় করেছেন, হোটেল বয়ের চাকুরী করেছেন, মুসলিম বয় হোটেলে থাকলে হিন্দুরা সে হোটেলে আহার করবে না বলে তিনি, মানিক চৌধুরী নাম ধরণ করে চাকুরী করেছেন, তারপরও জিয়া শাহীর নিকট মাথানত করেননি, মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করেননি, এই হলো ‘মহিউদ্দিন’ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা।

ওয়ান ইলাভেনের সময় মহিউদ্দিন চৌধুরী জেলে। তাঁর প্রাণপ্রিয় মেয়ে টুম্পার ক্যান্সার, মেয়ে বিদায় বেলায় বাবাকে শেষ বারের মত দেখতে বাবার কাছে চিঠি লেখেন, ‘বাবা আপনার চেহারাটা একবার দেখতে চাই’। এই কঠিন সময় মোছলেখা দিয়ে প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাব দিলে মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, আমি মুক্তি পেলেও আমার মেয়েকে বাঁচাতে পারবো না, কিন্তু আমার বোনের (শেখ হাসিনা) রাজনীতির কী হবে ? জননেত্রী শেখ হাসিনার ভবিষ্যত রাজনীতির কথা চিন্তা করে জীবিত মেয়ের মুখ দেখেননি। এই ঘটনা হতে আজকের রাজনীতিকদের অনেক কিছু শিখার আছে। সবদিক দিয়ে একটি মানুষ সফল হয় না। আমরা দেখতে পাই সফল নেতা হলে সফল প্রশাসক হয় না, মহিউদ্দিন চৌধুরী এক সাথে সফল নেতা ও প্রশাসক ছিলেন।

তিনি ছিলেন শিক্ষা স্বাস্থ্য যোগাযোগ এবং পরিচ্ছন্ন নগরীর পথিকৃৎ। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবার কাজ সিটি মেয়রের নয়। পুরো দেশের সিটি কর্পোরেশনগুলোর পরিচালনাধীন বিশটি স্কুল এবং কলেজও নেই, অথচ তিনি প্রায় ৫০টি স্কুল এবং কলেজ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মাধ্যমে পরিচালনা করতেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়। কয়েকটি মাতৃসদন হাসপাতালসহ প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স চালু করেন।

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মাধ্যমে ৪৫০টি ফোরকানিয়া মাদ্রাসা পরিচালনার দায়িত্ব নিজ হাতে নিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। বাংলাদেশে প্রথম তিনি লাশের এসি গাড়ী এবং এসি পাবলিক টয়লেট চালু করেন। ১৭ বছর একটাকাও টেক্স না বাড়িয়ে নগরীর ব্যাপক উন্নয়ন করা এক মিরাকল বিষয়। অথচ ২০০১-০৬ মেয়াদে বিএনপি জামায়াত জোট সরকারের সময় সিলেট সিটি কর্পোরেশনের চেয়েও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে কম টাকা বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছিল।

তখন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন হতে পাঠানো সব প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে আটকে দেওয়াই ছিল নিয়ম। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া অন্যান্য মেয়রদের বলতেন,টেক্স না বাড়িয়ে  কীভাবে উন্নয়ন করতে হয় তা মহিউদ্দিন চৌধুরীর নিকট হতে শিখে এসো।কোন কোন নেতা চেয়ারের দ্বারা দামী হয়, কোন কোন নেতা চেয়ার কে দামী করে।মেয়রের চেয়ার মহিউদ্দিন চৌধুরীকে দামী করতে পারেনি, 'মেয়র' পদকে তিনি অনেক বেশি দামী করেছেন।

মহানবী হযরত মোহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, 'যার দস্তরখানা যত বড় তিনি মানুষ হিসেবে তত বড় '। মহিউদ্দিন চৌধুরী প্রতিদিন শত শত মানুষকে খাওয়াতেন, তার দস্তরখানা  ছিলো অনেক বড়। একদিন তাঁর চশমা হিলস্থ বাসা হতে জুতা চুরি করে এক ছেলে নিয়ে যাওয়ার সময় দারোয়ানের হাতে ধরা পড়ে যায়। চোরকে মহিউদ্দিন চৌধুরীর হাতে অর্পন করলে তিনি চোরকে বেঁধে মারার এবং জেলে দেয়ার ভয় দেখান। হঠাৎ কথার মাঝে বলে বসেন, 'আগে ভাত খেয়ে নে,তারপর তোর বিচার '। এই হলো মহিউদ্দিন চৌধুরী। ঘূর্ণিঝড়ে গার্মেন্ট দুর্ঘটনায়, ভূমিকম্পে বহু মানুষের পচাগলা প্রচণ্ড দূর্গন্ধযুক্ত মৃত লাশের গোসল, দাপন-কাফন, জানাজা নিজেই করতেন।

চট্টগ্রামের মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত  হতো, ' যেখানে দুর্দিন সেখানে মহিউদ্দিন'। রাজপথে শ্লোগান উঠতো, সুখের দিন দুখের দিন'মহিউদ্দিন মহিউদ্দিন'। বাংলাদেশে তিনি প্রথম হজ্ব কাফেলা প্রতিষ্ঠা করে নিজ হাতে হাজীদের সেবা করেছেন। যে দলের মানুষ হোক, যে ব্যাক্তি তাঁর সাথে হজ্ব করেছেন, সে তার ভক্তে পরিনত হয়েছে। কারাজীবনে সব দলের মানুষের সেবা করতেন। সত্য  বলতে কী কাজই ছিলো তাঁর আনন্দ।

মহানবী হযরত মোহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করে গেছেন, যিনি মানবতার সেবায় নিজের জীবন কে নিঃশেষে বিলিয়ে দেন তিনিই মহামানব। মহিউদ্দিন চৌধুরী সমস্ত ধন ধ্যান সময় চিন্তা চেতনা ছিলো মানব কল্যানের রাজনীতি। এই সাধারণ মানুষের রাজনীতিক রাজনীতি করতে গিয়ে তার ব্যাক্তিগত জীবন বলতে কিছুই ছিলোনা।
লেখক: ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী
কলাম লেখক ও রাজনীতিক

কোন মন্তব্য নেই

please do not enter any spam link in the comment box.

merrymoonmary থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.