সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম একজন সৎ ও অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন রাজনৈতিক নেতার পথিকৃৎ।
সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ভারত উপমহাদেশের বিরলপ্রাণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ১৯৫২ সালের ১লা জানুয়ারি ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণ করেন তার পিতা বাংলাদেশের মুজিবনগর অস্থায়ী সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম।আশরাফুল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে মুক্তি বাহিনীর একজন সদস্য ছিলেন। তিনি ছাত্র জীবন থেকেই রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। বৃহত্তর ময়মনসিংহের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং কেন্দ্রীয় সহ-প্রচার সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
কিশোরগঞ্জ অসংখ্য কীর্তিমান মানুষের জন্মস্থান। মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান, বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রয়াত মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, র্যাংলার আনন্দমোহন বসু, পণ্ডিত শ্রীনীরদচন্দ্র চৌধুরী, মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, বিপ্লবী রেবতী মোহন বর্মন, শহীদ ডা. আবদুল আলীম চৌধুরী, শাহনামা অনুবাদক কবি মনিরউদ্দীন ইউসুফ এর মতো অনেক বিখ্যাত লোকের জন্মস্থান কিশোরগঞ্জ।
সেই কিশোরগঞ্জে ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম জন্মগ্রহণ করেন। রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম হওয়াতে তিনি শৈশব থেকেই রাজনৈতিক পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে থাকেন, এরপরে কৈশোর পেরোতে না পেরোতেই জড়িয়ে পরেন ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে। তার পিতা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সহচর এবং আওয়ামী রাজনীতির অন্যতম কাণ্ডারি, সেই সুবাদে তিনি হতে পারতেন ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতা, কিন্তু তিনি বেছে নিলেন ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ, কেন্দ্রিয় ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক পদেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ছাত্র রাজনীতির গণ্ডি ছাপিয়ে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের রাজনীতির আলপথের অন্যতম পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ।
মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে ছিলেন মুজিব বাহিনীর বীর যোদ্ধা, মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির সন্তান হয়েও যুদ্ধ করেছেন আর দশজন সাধারণ যোদ্ধার মতোই, মুজিব বাহিনীর প্রশিক্ষক জেনারেল উবান তার বইতে উল্লেখ করেছিলেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মুক্তিযুদ্ধে নিবেদিতপ্রাণ যোদ্ধা হিসেবে দায়িত্ব পালনের কথা। ক্ষমতার শীর্ষে থেকেও লোভহীন জীবন বেছে নেওয়ার ঘটনা এই উপমহাদেশের রাজনীতিতে খুবই বিরল, সৈয়দ নজরুলপুত্র আশরাফুল ইসলাম সেই বিরলপ্রাণ রাজনীতিবিদদের মধ্যে অন্যতম।
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্য তিন জাতীয় নেতার সাথে সৈয়দ নজরুল ইসলামকেও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিলো। পিতার মৃত্যুর পর সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম যুক্তরাজ্যে চলে যান, এবং লন্ডনের হ্যামলেট টাওয়ারে বসবাস শুরু করেন। লন্ডনে বসবাসকালে তিনি বাঙালি কমিউনিটির বিভিন্ন কার্যক্রমে জড়িত ছিলেন। সেসময় তিনি লন্ডনের বাংলাদেশ যুবলীগের সদস্য ছিলেন।
ঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার আহবানে ১৯৯৬ সালে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দেশে ফিরে আসেন এবং ১৯৯৬ সালের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত কিশোরগঞ্জ-১ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে বিপুল ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সেই আমলে তিনি বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি ২০০১ সালেও বিপুল ভোটে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত তিনি পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন।
২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে মন্ত্রীসভা গঠিত হলে তিনি স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং পুনরায় স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। ২০১৫ সালের ৯ জুলাই তার অসুস্থতাজনিত কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রিত্ব থেকে সরিয়ে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করেন। এক মাস এক সপ্তাহ দপ্তরবিহীন মন্ত্রী থাকার পর ১৬ জুলাই প্রধানমন্ত্রী নিজের অধীনে রাখা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন তাকে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছেন নির্বাচনী এলাকায় অনুপস্থিত থেকেও। ব্যাংককের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম শপথ নেওয়ার পূর্বেই মারা যান।
সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের রাজনৈতিক বিচক্ষণতা নিয়ে সন্দেহ নেই তার চরম রাজনৈতিক প্রতিপক্ষেরও। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তার দায়িত্বপালনকালীন রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিলো অন্য যেকোনও সময়ের থেকেও কঠিন পর্যায়ে। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক দৃঢ়তায় ও সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বিচক্ষণতায় বাংলাদেশ সেই বৈরি পরিবেশ কাটিয়ে ওঠে।
সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ভারত উপমহাদেশের বিরলপ্রাণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যিনি মুজিববাদী রাজনৈতিক দর্শনকে ধারণ করেন সর্বাঙ্গে। ব্যক্তিগতভাবে আমি তার অপার স্নেহ পেয়েছি, এটা আমার সারাজীবনের অর্জন। মানুষকে ভালোবাসার অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছেন তিনি
সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম মনে করতেন, জনগণই রাজনৈতিক দলের গণভিত্তি হবে, শুধুমাত্র কোনো পোষাকী বাহিনীর উপর নির্ভর করে গণতান্ত্রিক সরকার পরিচালনা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। সততা ও সহিষ্ণুতা রাজনৈতিক নেতাদের আদর্শ হওয়া বাঞ্চনীয় বলেও তিনি বিশ্বাস করতেন। তিনি ছিলেন একজন সৎ ও অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন রাজনৈতিক নেতার পথিকৃৎ।
তিনি ফুসফুসের ক্যান্সারে ভুগছিলেন। নভেম্বর ২০১৮ সালে তার ফুসফুসের ক্যান্সার ৪র্থ ধাপে পৌঁছে। ২০১৯ সালের ৩রা জানুয়ারি থাইল্যান্ডের ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।৬ জানুয়ারি ঢাকার বনানী কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।
কোন মন্তব্য নেই
please do not enter any spam link in the comment box.