Header Ads



মাঠ ও মাটির নেতা মহিউদ্দিন চৌধুরী-ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী

 

মাঠ ও মাটির নেতা মহিউদ্দিন চৌধুরী

রাজপথে আমরা  শ্লোগান উচ্চারণ করতাম। যখন থাকে দুর্দিন, পাশে থাকে মহিউদ্দিন। সুখের দিন দুঃখের দিন, মহিউদ্দিন-মহিউদ্দিন।

ছোট একটি প্রবন্ধে আলহাজ্ব এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পর্কে লেখা কঠিন। দীর্ঘদিন তাঁর সান্নিধ্যে থাকার কারণে যেসব স্মৃতি জমা হয়েছে তা ক্ষুদ্র পরিসরে তুলে আনা সম্ভব নয়। ৩০ বছরের লেখালেখির জীবনে কখনো সংকটে পড়িনি। মহিউদ্দিন চৌধুরী সম্পর্কে লেখতে গেলে কলম থমকে দাঁড়ায়। কোথা হতে শুরু করবো, কোথায় শেষ করবো সিদ্ধান্ত নেওয়া কষ্টের। কোন বিষয়টি লেখবো কোন বিষয়টি বাদ দেবো দ্বেদ্ব পড়ি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কলম থমকে দাঁড়ায়। স্মৃতির ভান্ডারে ডুবে থাকতে হয়। তারপর কিছু লেখতে চেষ্টা করি। স্বামী বিবেকানন্দ বলতেন, ‘সমুদ্রের তীরে বসে কূল খনন করিতেছো কেন ? তাঁর সম্পার্কে লেখা মানে আমার নিকট সমুদ্রের তীরে বসে কুপ খনন করার মত।

তিনি ছিলেন, শোষিত বঞ্চিত নির্যাতিত মানুষের জননেতা। জনগণের ভাষা, স্বার্থ, মনের কথা তিনি বুঝতে পারতেন। ঊনষত্তরের গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বিদ্রোহ, বিপন্ন মানুষ রক্ষা এবং সেবার মধ্যদিয়ে তিনি সাধারণ ছাত্রনেতা হতে গণমানুষের নেতায় পরিণত হন। মানুষের দুঃখ কষ্টে পাশে থাকাই ছিল তাঁর প্রশান্তি। তাঁর ঘরে সবশ্রেণীর মানুষের ছিল প্রবেশাধিকার। কোন কোন সরকারি অফিসার ফোন করে জানতে চাইতেন, তাঁর বাসায় আসতে পারবেন কিনা ! তিনি সাথে সাথে বলতেন, ‘আমি কোন সরকারি অফিসার বা আমলা নই যে আমার ঘরে কুত্তা-দারওয়ান থাকবে। প্রকৃত রাজনীতিকের বাসায় কুত্তাও থাকে না দারওয়ানও থাকে না।

তিনি তখন বাসায় বাইরে থাকতেন তখন নানা কর্মসূচি নিয়ে চষে বেড়াতেন। আর যতক্ষণ বাসায় থাকতেন, ততক্ষণ সব শ্রেণীর মানুষের সমাবেশ থাকতো। অভাবি ছাত্র, শিক্ষক, শ্রমিক, রাজনীতিসহ নানা শ্রেণীর মানুষকে সাহায্য সহযোগিতা করতেন। তখন কারো উপর রাগ দেখাতেন, কারো গালি দিতেন, আবার মুহূর্তের মধ্যে ভালোবাসার যাদুমন্ত্রে মুগ্ধ করে আপন করে নিতেন।

একদিন জুতাচোর মহিউদ্দিন ভাইয়ের জুতা চুরি করে বাসা হতে নিয়ে যাওয়ার কালে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। পুলিশ চোরকে মহিউদ্দিন চৌধুরীর হাতে সোপর্দ করলে, তিনি রাগান্বিত ভঙ্গিতে চোরকে বোঁধে মারার হুংকার দেওয়ার মাঝখানেই হঠাৎ বলে বসনে, ‘আগে ভাত খেয়ে নেয়, তারপর তোর বিচার। এই হলো মহিউদ্দিন চৌধুরী। তাঁর চশমা হিল বাস ভবনে সব শ্রেণীর মানুষের জন্য দুপুর ও সন্ধ্যায় কয়েকশত লোকের আহারের ব্যবস্থা হতো। যেন দুই বেলাই মেজবান। কেউ আহার না করে ফিরে যেতে পারতো না। কর্মীদের খাওয়াতে পারলে তিনি মনে মহা প্রশান্তি অনুভব করতেন। এমন রাজনীতিকের অভাব চিরকালই থাকবে। যেসব বিরোধী নেতা রাজপথে মহিউদ্দিন চৌধুরীর প্রচন্ড বিরোধিতা করতো, তাদের বিপদেও তিনি সাহায্যের হাত প্রসারিত করতেন।

ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহুরলাল নেহেরু বলতেন, ‘কোন কোন নেতা দলীয় নেতা, কোন কোন নেতা জননেতা। দলীয় নেতা হওয়া সহজ কিন্তু জননেতা হওয়া কঠিন। যে নেতা সব ধরনের মানুষের কল্যাণ এবং জনগণের অধিকার আদায়ে প্রাণ দিতেও কুণ্ঠিত হয় না প্রকৃতপক্ষে তিনিই জননেতা। এক্ষেত্রে মহিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন প্রকৃত জননেতা। সবশ্রেণীর মানুষের দুর্দিনে পাশে থাকতেন তিনি। তাই রাজপথে আমরা  শ্লোগান উচ্চারণ করতাম। যখন থাকে দুর্দিন, পাশে থাকে মহিউদ্দিন। সুখের দিন দুঃখের দিন, মহিউদ্দিন-মহিউদ্দিন। ক্ষমতাসীন থাকার সময়ও রাজপথ তাঁর দখলে থাকতো। তিনি বলতেন, ‘রাজপথে থাকলে পতনের ভয় নেই। 

তিনি ছিলেন প্রকৃত মাঠ ও মাটির নেতা। মানুষের অধিকার আদায় ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁর নির্দেশে পিচঢালা রাজপথে প্রতিদিন মিটিং মিছিল চলতে থাকতো। আমরা তাতে অংশগ্রহণ করতাম। কর্মপাগল মহিউদ্দিন চৌধুরী কর্ম ছাড়া এক মিনিটও শান্তি পেতেন না। কত ধরনের আন্দোলন তিনি করে গেছেন তার নেই ইয়ত্তা। ব্যস্ততাই যেন তাঁর সুস্থতা, তিনি ছিলেন রাজপথের রাজনীতির শিক্ষক। রাজনীতিবিদদের তিনি শিখিয়ে গেছেন, মানুষের কাছে পৌঁছতে গেলে কত ধরনের আন্দোলন সংগ্রাম করতে হয়। আর লাগাতার কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে অপশক্তিতে কী ভাবে প্রচন্ড নাড়া দেওয়া যায়।

১৭ বছর মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করে এক টাকাও হোল্ডিং টেক্স বৃদ্ধি না করে কী করে ব্যাপক উন্নয়ন করা যায় তা অনেক জাতীয় নেতৃবৃন্দ অন্যান্য মেয়রদেরকে তাঁর নিকট শিখতে বলতেন। বাংলাদেশের সিটি কর্পোরেশনগুলোর মধ্যে তাঁর আমলে চট্টগ্রাম শহর ছিল সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন নগরী। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া পর্যন্ত অন্যান্য মেয়রদের বলতেন মহিউদ্দিন চৌধুরীকে অনুসরণ করতে। তাঁর স্বপ্ন ছিল চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে আর্থিক ভাবে স্বনির্ভর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা। তার জন্য প্রচুর কাজও তিনি করেছেন। তাঁর স্বপ্ন পূরণের জন্য কোন আর্থিক সাহায্য চাইতেন না। শুধু চাইত প্রকল্পগুলো অনুমোদন। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় প্রকল্পগুলোর অনুমোদন মিলতো না বলে দুঃখ প্রকাশ করতেন।

তিনি চট্টগ্রামের অধিকারের প্রতীক। সাহসের প্রতীক। চট্টগ্রামের স্বার্থ বিরোধী কোন চক্রান্ত হলে গর্জে উঠে বলতেন, আমি মহিউদ্দিন মানি না’। তিনি বিশ্বাস করতেন, ৬৮ হাজার গ্রাম নয়, একটি গ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে, তার নাম চট্টগ্রাম। জাতীয় রাজস্বের সিংহভাগই চট্টগ্রাম বন্দর যোগান দেয়। চট্টগ্রামের উন্নয়ন মানে সমগ্র বাংলাদেশের উন্নয়ন। এটি কোন আঞ্চলিকতার বিষয় নয়। চট্টগ্রামের অধিকারের আন্দোলন করতে করতে ‘মহিউদ্দিন চৌধুরী, ‘চট্টগ্রাম’ সমার্থক হয়ে উঠে। তাই তাঁর মুখে শোভা পেত ‘আমার চট্টগ্রাম’।

তাঁকে কয়েকবার মন্ত্রিত্ব ও প্রেসিডিয়াম সদস্য হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তা তিনি গ্রহণ করেননি। এসব গ্রহণ না করে তিনি কী চান এমন প্রশ্নের জবাবে বলতেন, আমি চট্টগ্রামের মহিউদ্দিন, চট্টগ্রামবাসীর অধিকারের আন্দোলনে থাকতে চাই। এসব পদ পদপদবী ধার ধারি না। চট্টগ্রামের মানুষের অধিকারের আন্দোলন করতে করতে তিনি ইহজগৎ ত্যাগ করেছেন। সাংবাদিক সমীর কান্তি বড়–য়া সুন্দর লেখেছেন, চট্টগ্রামের প্রতি ইঞ্চি মাটি খুঁড়লেই মহিউদ্দিন চৌধুরীর অবদানের নিদর্শন পাওয়া যাবে। তিনি শুধু আওয়ামী লীগের সম্পদ নয়, ছিলেন জাতীয় সম্পদ। আঞ্চলিক নেতা হয়েও দেশের মানুষের নিকট জাতীয় নেতার সম্মানে অধিষ্ঠিত ছিলেন। 

আমেরিকার একটি কোম্পানী এসএস এ চট্টগ্রামের বন্দরের মোহনায় পোর্ট প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা চালালে তিনি তীব্র প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে তুলেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূত হোলজম্যান মেয়র অফিসে সাক্ষাৎ করে এই বন্দর প্রতিষ্ঠার জন্য ১০ বিলিয়ন ডলার ঘুষ দিতে চাইলে তিনি ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করেন। সাথে সাথে এই সংবাদ মিডিয়ার মধ্যে প্রকাশ করে দেন। বঙ্গবন্ধুর পর বাংলাদেশের তিনিই প্রথম ক্ষমতাসীন ব্যক্তি যিনি মার্কিন বিরোধী প্রকাশ্যে অবস্থান গ্রহণ করেন। তিনি সেদিন দেশের স্বার্থে নিজ দলের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করতে চিন্তা করেননি। তিনি মনে করতেন চট্টগ্রাম বন্দর পুরো দেশেরই সম্পদ। এই বন্দর সমগ্র বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা।

তিনি ছিলেন আপোসহীন নেতা। ক্ষমতার জন্য কারো সাথে আপোস করেননি, এমন কী নিজ দলের সাথেও নয়। স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছেন, জেল কেটেছেন, জিয়া সরকারের শাসনামলে প্রচÐ অত্যাচার হতে বাঁচার জন্য দেশান্তরিন হয়ে কলকাতায় চায়ের দোকানে চাকুরী করেছেন, পত্রিকার হকারের কাজ করেছেন কিন্তু কখনো কোনদিন আপোষ করেননি। চট্টগ্রামের জন্য দাপট নিয়ে কথা বলার লোক হারিয়ে আমরা এতিম হয়েছি। তাঁর একদিনের কর্মকান্ড নিয়ে দুইটি, তিনটি প্রবন্ধ লেখা যায়।

চট্টগ্রামের মানুষ সঙ্কটকালে মহিউদ্দিন চৌধুরীর মুখের দিকে চেয়ে থাকতো। কী বলছেন তিনি। কী তাঁর প্রতিক্রিয়া। সর্বদলের মানুষ বিশ্বাস করতো তিনি এগিয়ে আসলে সঙ্কট নিরসর হবে। প্রকৃতপক্ষে তাই হতো। মহিউদ্দিন ভাই ছিলেন চট্টগ্রামের মানুষের জন্য বিশাল এক ছাতা। সে ছাতার নিচে থাকতে আমাদের কোন ভয় ছিল না। সে ছাতা আজ সরে গেছে। যখন এই ছাতা আমাদের ছায়া দিত তখন এই ছাতার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারিনি। কবি সৈয়দ শামসুল হকের আঞ্চলিক কবিতার একটি পংক্তি দিয়ে লেখার ইতি টানতে চাই। ‘মানুষ এমন তয়, একবার পাইবার পর/ নিতান্ত মাটির মনে হয়, তার সোনার মোহর।’

লেখক : ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী

কলামিস্ট ও রাজনীতিক

কোন মন্তব্য নেই

please do not enter any spam link in the comment box.

merrymoonmary থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.