তারুণ্যের জেগে ওঠার নাম শেখ কামাল
শেখ কামাল যেসব অসামান্য কর্ম দিয়ে প্রিয় এ মাতৃভূমি কে সাজিয়েছেন, তা প্রজন্মের পর প্রজন্ম স্মরণ রাখবে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও আন্তরিকতায়।
জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল। ১৯৪৯ সালের আগস্টের এই দিনে তাঁর জন্ম। বেঁচে থাকলে তাঁর বয়স হতো ৭৩বছর।তিনি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এবং ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।
১৯৪৯ সালের ৫ আগস্ট তিনি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন।
শেখ কামাল শাহীন স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক (সম্মান) পাস করেন। তিনি ছায়ানটের সেতারবাদন বিভাগেরও ছাত্র ছিলেন।
শেখ কামাল বন্ধু শিল্পীদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ‘স্পন্দন শিল্পীগোষ্ঠী’। ব্যক্তিজীবনে তিনি শিল্প-সংস্কৃতির পাশাপাশি ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, বাস্কেটবলসহ বিভিন্ন খেলাধুলায় উৎসাহী ছিলেন। তিনি ছিলেন আবাহনী ক্রীড়া চক্রের প্রতিষ্ঠাতা।
১৯৭৫ সালের ১৪ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ব্লু’ খ্যাতিপ্রাপ্ত দেশবরেণ্য অ্যাথলেট সুলতানা খুকুর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। ছাত্রলীগের একজন নিবেদিত, সংগ্রামী ও আদর্শবাদী কর্মী হিসেবে ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন শেখ কামাল।
তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ওয়ার কোর্সে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে মুক্তিবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
স্বাধীনতার পর শেখ কামাল সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি নিয়ে পুনরায় লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করেন।
তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য এবং পরে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন জাতীয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শাহাদাৎ বরণের সময় তিনি সমাজবিজ্ঞান বিভাগের এমএ শেষ পর্বের পরীক্ষা দিয়েছিলেন।
শেখ কামাল একাধারে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, রাজনীতিবিদ, ক্রীড়া সংগঠক, সাংস্কৃতিক সংগঠক ও সমাজ চিন্তক। তাঁর স্ত্রী সুলতানা কামালও বিশিষ্ট ক্রীড়াবিদ ছিলেন। বিবাহিত জীবনে প্রবেশের এক মাসের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট গোটা পরিবারের সঙ্গে তাঁকেও শাহাদাৎ বরণ করতে হয় বাংলাদেশ বিরোধী নর্দমার কীটদের হাতে।
মানুষ হিসেবে শেখ কামাল ছিলেন অলরাউন্ডার। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে রাজনীতির মাঠে তাঁর প্রয়োজনীয়তা যখন অনিবার্য, ঠিক তখন’ই তাঁকে পাওয়া গেছে খেলার মাঠে, গানের আসরে, নাটকের মঞ্চে, সেতারের সুরে, বন্ধুদের আড্ডায় ও ছাত্ররাজনীতির স্লোগানে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী জাতির পিতাকে আটক করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়ার পর মা-মাটি-মাতৃভূমির সম্ভ্রম রক্ষায় মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন শেখ কামাল।
মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক আতাউল গনি ওসমানীর এডিসি হিসেবে দেশকে স্বাধীন করতে তিনি রাখেন বীরত্বব্যঞ্জক ভূমিকা।
একজন ছাত্র সংগঠক হিসেবে তিনি কখনও নেতৃত্বের শীর্ষে আসতে চাননি। তিনি’ই ছাত্রলীগকে সংগঠিত করতেন, প্রেরণা জোগাতেন।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ছাত্ররাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন তিনি। ছিলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা, পরবর্তীতে জাতীয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা।
মহান মুক্তিযুদ্ধের পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন দেশ গঠনের কাজে নিজেকে সমর্পণ করেছেন, তখন পিতার কাজে সহায়তা করার পাশাপাশি বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের উন্নয়নে কাজ শুরু করেছেন তিনি।
তাঁর হাতের ছোঁয়ায় নিমেষেই বদলে গিয়েছিল বাংলাদেশের ফুটবল, ক্রিকেট, হকিসহ বিভিন্ন খেলাধুলা। আবাহনী ক্রীড়া চক্রের মত একটি ক্রীড়া প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাঁর হাতে।
ঢাকার শাহীন স্কুলে অধ্যয়নকালে শেখ কামাল ছিলেন স্কুলের প্রতিটা খেলার পরিচিত মুখ। নিখুঁত লাইন-লেন্থের একজন ফাস্ট বোলার হিসেবেও তাঁর সুনাম ছিল। তিনি আজাদ বয়েজ ক্লাবের হয়ে প্রথম বিভাগ ক্রিকেট খেলেছেন দীর্ঘদিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর তিনি ছিলেন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের বাস্কেটবল টিমের অধিনায়ক।
শুধু খেলাধুলা নয়- সঙ্গীত, বিতর্ক, অভিনয়, উপস্থিত বক্তৃতা থেকে শুরু করে কোথায় ছিলেন না শেখ কামাল? ‘স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠী’ প্রতিষ্ঠা করে তিনি বাংলা গানের নতুন ধারার সৃষ্টি করেছিলেন। ফিরোজ সাঁই, ফেরদৌস ওয়াহিদদের মতো জনপ্রিয় পপসঙ্গীত শিল্পীরা এসেছেন এই সংগঠনের মধ্য দিয়েই। বলা যেতে পারে, বাংলাদেশে পপ সঙ্গীতের সূচনা হয়েছিল শেখ কামালের হাত ধরে।
পাকিস্তান সরকার যখন রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করতে উঠেপড়ে লেগেছিল, তখন শেখ কামাল বিভিন্ন প্রতিবাদী সভায় নিজে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে বাঙলা ও বাঙালির প্রাণের রবীন্দ্রসঙ্গীতকে টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন। ছায়ানটের সেতারবাদনের ছাত্র হিসেবে সেতার বাজানোতেও তিনি তালিম নিয়েছিলেন।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ম. হামিদ যখন ডাকসুর সাংস্কৃতিক সম্পাদক, তখন ‘নাট্যচক্র’ নামে একটি নাটকের সংগঠন গড়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেই নাট্য সংগঠনের প্রতিষ্ঠাকালীন যুগ্ম-আহ্বায়ক ছিলেন শেখ কামাল।
এই নাট্য সংগঠনের অভিনয়শিল্পী হয়েই নাট্যজন ফেরদৌসী মজুমদারের সঙ্গে কলকাতায় মঞ্চ নাটকে অভিনয় করতে গিয়েছিলেন তিনি। নাটক শেষে ফেরদৌসী মজুমদার ও শেখ কামালের অটোগ্রাফ নিতে সেদিন দর্শকরা হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল।
তিনি বেঁচে থাকলে হয়তো আমাদের ছাত্ররাজনীতি, জাতীয় রাজনীতি, সংস্কৃতি, অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন সূচিত হতো। দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে আজ কণ্টকাকীর্ণ যে দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হচ্ছে, শেখ কামাল বেঁচে থাকলে হয়তো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এতোটা বন্ধুর পথ তাকে পাড়ি দিতে হতো না।
মাত্র ২৬ বছরের ক্ষুদ্র জীবনে শেখ কামাল যেসব অসামান্য কর্ম দিয়ে প্রিয় এ মাতৃভূমিকে সাজিয়েছেন, তা প্রজন্মের পর প্রজন্ম স্মরণ রাখবে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও আন্তরিকতায়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে মাত্র ২৬ বছর বয়সে পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে তাকেও ঘাতকরা হত্যা করে।
কোন মন্তব্য নেই
please do not enter any spam link in the comment box.