Header Ads



আমার ছাত্র রাজনীতির কিছু নাবলা কথা-এ কে এম বেলায়েত হোসেন।

 

আমার ছাত্র রাজনীতির কিছু নাবলা কথা

৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন। আমার ছাত্র রাজনীতির কিছু নাবলা কথা ।

১৯৬২ সালের কথা। আমি সৈয়দপুর কায়দে আযম কলেজে (বর্তমান-সৈয়দপুর গভঃকলেজ)আই,এ,দ্বীতিয় বর্ষ এর ছাত্র। সামরিক শাসক জেনারেল আয়ুব খান ঘোষিত শিক্ষা কমিশন এর বিরুদ্ধে ঢাকা -রাজশাহী বিশ্ব বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গঠিত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ শিক্ষা আন্দোলন শুরু করে। ঢাকাএবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর পুলিশ গুলি বর্ষণ করে। কয়েক জন ছাত্র জনতা হতাহত হয়। এরই প্রতিবাদে সারা পূর্বপাকিস্তানে দিন ব্যপি হরতাল,বিক্ষোভ মিছিল ও বিক্ষোভ সমাবেশ এর ডাক দেয়া হয়। আমি তখন কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারন সম্পাদক। ভি,পি, ছিল বানিজ্য বিভাগের বি,কম,১ম বর্ষের ছাত্র মৌলভী ইদ্রিছ আলম। পরে বুঝেছিলাম ইদ্রিছ আলম মূলতঃ ডান পন্থি ভাব ধারার লোক। তার সাথে ছাত্র সংগের সম্পর্ক ছিল। সকাল এগারটায় কলেজ ক্যাম্পাস থেকে মিছিল বের করে শহরের প্রধান সড়ক গুলো প্রদক্ষিণ করে ফিরে এসে জিন্নাহ পার্কে এসে বিক্ষোভ সমাবেসের জন্য সমবেত হলাম। বিভিন্ন স্কুল থেকে খন্ড খন্ড মিছিল নিয়ে শিক্ষার্থীরা এসে জিন্নাহ পার্কের সমাবেশে যোগ দেয়।

বিকাল তিনটার কিছু পরে সভা আরম্ভ করতে গিয়ে সভাপতিত্ব করার জন্য মৌলভী ইদ্রিছকে খুজে পাওয়া গেলনা। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে আমাকেই সভাপতিত্ব  করতে হয়। পরদিন দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় ১ম পৃষ্ঠার অষ্টম কলামে আমাদের মিছিল, মিটিং এর সংবাদ গুরুত্বসহকারে প্রকাশিত হয়। জাতীয় দৈনিকে সেদিন আমার নেতৃত্বে মিছিল এবং আমার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভার সংবাদ Prominently পরিবেশিত হওয়ায় ছাত্র রাজনীতি বিষয়ে আমার উৎসাহ উদ্দিপনা বহুগুন বৃদ্ধি পায়। পরদিন আমি কলেজে অধ্যাপক দলিলুর রহমান স্যার এর (উর্দু ভাষি) অর্থনীতির ক্লাস করছিলাম। কলেজের বেয়ারা ইসহাক (সেও বিহারি)এসে বলল, "স্যার, বেলায়েত ছাবকো প্রিন্সিপাল ছাবনে বোলা রাহা।

 কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই অধ্যাপক স্যার বললেন,"Mr. Belayet, you may go". আমি প্রিন্সিপালের (তিনিও ছিলেন URDU SPEAKING) চেম্বারের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখলাম সাদা পোষাক পরিহিত, সম্পূর্ণ সাদা ছাপ দাড়িওয়ালা একভদ্রলোক প্রিন্সপাল সাহেবের সামনে বসে কথা বলছেন।আমি,"May I come in sir" বলতেই প্রিন্সিপাল তাঁর সামনের ভদ্র লোককে বললেন, "He is Mr.Belayet ".ততক্ষনে আমি চেম্বারে প্রবেশ করেছি। ভদ্রলোক উঠে এসে আমার হাত ধরে বললেন,'চলুন বেলয়েত সাব, আমরা বাইরে গিয়ে কথা বলব।'বুঝলাম আর যাই হোক ভদ্রলোক বাঙ্গালী। দোতলা থেকে আমাকে নিয়ে নীচে নামলেন এবং কলেজের মাঠ পেরিয়ে প্রধান সড়কে উঠলেন। সেখানে সাদা পোষাক পরিহিত দু'জন লোক একটি রিক্সায় বসে আছে। 

তাদের সামনে অন্য একটি খালি রিক্সা দাড়িয়ে আছে। আমার সাথের ভদ্রলোক আমাকে নিয়ে খালি রিক্সায় উঠলেন। আমি এখনও বুঝতেছিনা কেন আমি একটিও কথা না বলে ভদ্রলোকের কথামত তাকে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় অনুসরন করছিলাম? রিক্সা প্রধান সড়ক ধরে চলতে শুরু করল। অপর রিক্সাটি আমাদেরকে অনুসরন করে সামনে এগুচ্ছিল। সৈয়দপুর রেল স্টেশনের কাছে পৌছলে রিক্সাকে ডান দিকের সরু রাস্তায় ঢুকতে বলল। এটা ছিল ডি,আই,বি, অফিসের প্রবেশ পথ। বিরাট লম্বা 'এল' সাইজের সেমি -পাকা বিল্ডিং। বারান্দার পার্শ্বে গিয়ে রিক্সা থেকে নামলাম। এসময় মনে হল আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, অথবা গ্রেপ্তার পূর্ব জিজ্ঞাশাবাদের জন্য আনা হয়েছে।

একটি বড় সর কক্ষে আমাকে নিয়ে বসানো হলো।সংগের লোকটি আমাকে বলল, একটু পরে সাহেব আসবেন, আপনার সাথে ছাত্রদের আন্দোলন বিষয়ে আলোচনা করবেন। আপনি কোন চিন্তা করবেননা। এখানে আমরা প্রায় সবাই বাঙ্গালী। কিছুক্ষনের মধ্যে অফিসার আসলেন। আমি দাঁড়িয়ে সালাম দিতেই তিনি হাসি মূখে বললেন, বেলায়েত সাহেব,কেমন আছেন ? যতদুর মনে পরে আমি তাঁর প্রশ্নের জবাব দেয়ার আগেই তিনি আমাকে বসতে বললেন। প্রথমে তিনি তাঁর নাম আবিদ আলি এবং ওনার দেশের বাড়ী বললেন কুমিল্লা। পিয়নকে চা বিস্কুট আনার জ্ন্য বললেন। চা খেতে খেতে জিজ্ঞেশ করলেন, বাবার নাম, সন্দ্বীপে কোন গ্রামে বাড়ী,সৈয়দপুর কখন এসেছি ইত্যাদি। আমি যতদূর সম্ভব সংক্ষেপে তার প্রশ্নের জওয়াব দিচ্ছি। আসলে কলেজ থেকে শুরু করে এপর্য্যন্ত আমাকে নিয়ে একটি অন্য রকম পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। কি যেন কি ঘটতে যাচ্ছে এমনই একটা পরিস্থিতি। 

আমি ও মনে মনে খুব সন্ত্রস্ত হয়ে গেলাম। এর পর অফিসার বলতে লাগলেন :-"আপনিতো ভাল ছাত্র। অত দূর থেকে এসেছেন, ভালভাবে পড়া লেখা করবেন, আপনি এসব আন্দোলন সংগ্রামে জড়ালেন কেন ? তাও আবার নেতৃত্বের কাতারে। আমি বললাম কেউনা কেউতো নেতৃত্বে আসতে হবে। নইলে আন্দোলন চলবে কিভাবে ? আমাদের ক্লাশে বাঙ্গালী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৭ জন। এর মধ্যে মেয়ের সংখ্যা ১৯ জন। তারা মিছেলে মিটিং এ আসবেনা।বাকী শিক্ষার্থী সব বিহারি তারা ( মেয়েরা)মিছিলে মিটিং এ থাকবে কিন্তু নেতৃত্বে আসবেনা।

অফিসার বললেন-- 'আমরা চাই, আপনারা ভালভাবে পড়া লেখা করে সিএসপি, পিএসপি অফিসার হবেন। এসব সরকার বিরোধী আন্দোন করে সরকারী খাতায় নিজের রেকর্ড খারাপ করলে পরে অফিসার হওয়াতো দূরের কথা পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ ও পাবেনা। আমি বললাম-- আমরা বিএ,এমএ পাশ করা পর্যন্ত আয়ুব খান রাষ্ট্র ক্ষমতায় থকতে পারবেনা। অফিসার বললো--আয়ুব খান ক্ষমতায় থাকলেননা।

অন্য কেউ ক্ষমতায় আসল। তাতে এইযে বড় বড় লাল কভারের রেজিস্টার দেখছেন, এগুলো কিন্তু পরিবর্তন হবেনা। এই খাতায় যাদের নাম থাকবে তারা পাকিস্তানে যে কোন সরকরী চাকুরীর জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। এসয় হঠাৎ তাঁর টেলিফোন বেজে উঠল। ফোনে হ্যাল বলে দাড়িয়ে ছালাম দিয়ে বললেন-ইয়স স্যার,জি স্যার,আমার সামনে আছেন স্যার,হ্যাঁ স্যার আলাপ করছি স্যার,ঠিক আছে নিয়ে আসছি স্যার।

অফিসারের এরকম ফোনালাপ শুনে বুঝলাম কোন উর্ধতন পুলিশ কর্মকর্তার সাথে আমাকে নিয়েই এসব কথোপ -কথন। ঘটনার আকষ্মিকতায় আমি খুবই ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পরলাম। অফিসার আমকে নিয়ে বেড় হলেন। কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন কিছুই জানিনা।এবার দেখলাম পেচনে সাদা পোষাকদারি দু'জনের হাতে বন্দুক। 

আমাকে তারা ডিআইজি অফিসে নিয়ে গেলেন।ডিআইজি অফিসে পৌঁছে অফিসার স্যালুট দিয়ে দাড়াল। ভাগ্যক্রমে ডিআইজি এমএস হায়াদার বাঙ্গালী ছিলেন এবং তাঁর বাড়ী ও ছিল কুমিল্লা। ডিআইজি ঐ অফিসারকে বললেন, 'এটা আমি দেখছি।

 তোমরা যাও।আমি বিস্ময়াবিভুত হয়ে দেখলাম, ডিআইজি সাহেবের সামনে আমার অত্যন্ত প্রিয় রাষ্ট্র বিজ্ঞানের প্রফেসার মোহাম্মদ সফিউর রহমান এবং বাংলার অধ্যাপক সেলিম আহমেদ (সেলিম আহমেদ পরে চট্টগ্রাম সিটিকলেজের অধ্যাপক ছিলেন) বসে আছেন। ডিআইজি সাহেব প্রফেসার সফিউর রহমান সাহেবকে হেসে হেসে বললেন, আপনাদের প্রিয় ছা্ত্রকে এখন আপনার জিম্মায় নিয়ে যেতে পারেন। না লিখিত কিছু লাগবেনা।

তবে প্রয়োজনে আপনাদের সিএসপি সাহেবকে বলে দিবেন। সিএসপি বলতে ডিসি'র কথা বুঝিয়েছেন। ডিসি ছিলেন ওয়াছিউল মোস্তাফা কারনি ( ও,এম,কারনি)। তিনি ছিলেন পান্জাবী। আন্দোলন সংগ্রাম দমনে তাঁর কোন জুড়ি ছিলনা। প্রসংগ ক্রমে একটা কথা বলে রাখি। পাকিস্তান আমলে সিভিল সার্ভিসে যোগ দেয়ার জন্য CSP (CENTRAL SUPERIOR SERVICE) এবং পুলিস সার্ভিসের জন্য PSP (POLICE SERVICE OF PAKISTAN) EXAMপাশ করতে হতো। CSP অফিসাররা নিজেদেরকে সুপেরিয়র ভাবতেন এবং তারা PSP (পুলিশ) অফিসার দের সাথে এক টেবিলে বসে খেতেও চাইতেননা। একেই বলে আমলা। এরা নিজেদেরকে সর্বোচ্চ শ্রেণি পেশার বলে ভাবতো। ডিআইজি অফিস থেকে আমাকে নিয়ে প্রফেসার সাহেবরা কলেজে গেলেন। 


সেখানে সব শোনার পর  শিক্ষার্থীরা ক্লাশ থেকে বের হয়ে মাঠে এসে জড় হয়। প্রিন্সিপাল আমাকে কেন ক্লাশ থেকে ডেকে নিয়ে ডিবির লোকের হাতে তুলে দিল এজন্য শিক্ষার্থীরা প্রিন্সিপালের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিয়ে মিছিল সহকারে ক্যাম্পাস প্রদক্ষিন করে। এসময় প্রফেসার সফিউর রহমান সাহেব ছাত্রদের কয়জনকে ডেকে বললেন,তোমরা এখন বেলায়েতকে ইস্যু করে এসব করলে বেলায়েত গ্রেপ্তার হয়ে যেতে পারে। আপাততঃ এসব বন্দ্ধ কর। তাঁর কথায় ছাত্ররা শান্ত হয়ে যায়।

(ভুমি পুত্র বেলায়েত দিনান্তের কথা কাব্য এর পান্ডুলিপি থেকে।) 

এ,কে,এম বেলায়েত হোসেন

উপদেষ্টা চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ।


কোন মন্তব্য নেই

please do not enter any spam link in the comment box.

merrymoonmary থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.