সিআরবি'র ৭১'র শহীদ আবদুল হাসিম এবং বেঈমান বিহারী নার্স সামার কথা-আহসানুল কবির রিটন
![]() |
শহীদ আবদুল হাসিমের কবর |
হাসিমকে পাঞ্জাবিরা ধরে নিয়ে বাসার অদুরে যায় এবং নির্মমভাবে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে।
চট্টগ্রামের সিআরবি সাত রাস্তার মোড় ধরে সামান্য এগুলেই রাস্তার নিচের অংশে আবদুল হাসিম নামে একজনের কবর দেখা যায়। তিনি কিভাবে মারা গেছেন সেই ইতিহাস অনেকের জানা না থাকলেও কবরের গায়ে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ শব্দটি দেখে আমাদের নতুন প্রজন্ম নানা সময়ে সেই কবর পরিষ্কার করেছে। দেখানোর চেষ্টা করেছে সম্মাণ। তাদের প্রতি ধন্যবাদ জানানোর ভাষা আমার নেই।
তবে এর প্রকৃত ইতিহাসটা যদি জানতে পারেন তাহলে হয়তো তারা অনুধাবন করার চেষ্টা করবে যে, এই দেশ, এই পতাকা এমনি এমনি আসেনি। যাই হোক সেদিন কি ঘটেছিল তা তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
২০০৬-৭ সাল হবে। আমি তখন দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ পত্রিকায় কাজ করি। এসময় মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের হণহত্যা বিষয়ক প্রতিবেদন করার সময় এই কবরের রহস্য জানতে পারি।
সময়টা ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাস। বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতালের ওয়ার্ড অ্যাটেনডেন্স পদে কাজ করতেন চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর পূর্ব গোমদন্ডীর মোখলেসুর রহমানের পু্ত্র আবদুল হাসিম। চাকরির সুবাদে প্রায় তাকে সামা নামের এক বিহারী নার্সের নানা ফরমাস খাটতে হতো। সামা তার পরিবারের বাজার করা, কাপড় কাচা, বাচ্চাকে দেখাশোনা করাসহ অনেক কাজই করাতেন আবদুল হাসিমকে দিয়ে।
হাসপাতাল কলোনীতেই থাকতেন সামা। বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তার বাসায় পাঞ্জাবিদের আড্ডা বসতো। তাদের চাঙা রাখতে অনেক সময় সামা নিজেকে গনিমাতের মাল হিসেবে সমর্পন করতেন। কারণ, বলাতো যায় না যদি এই দেশটি চুড়ান্তভাবে পাকিস্তান হয়ে যায়।
যারা খুব কাছ থেকে হাসিমকে দেখেছেন তাদের কয়েকজন জানান, অসম্ভব মিশুক, সরল এবং সদালাপি এক লোক ছিলেন হাসিম। চমৎকার মুরালি বাঁশী বাজাতেন। তার বাঁশীর সুর শুনতে অনেকেই তার কাছে আসতেন। যদিও তার সরলতা তাকে মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছাতে সহায়তা করেছিল বলে ধারণা সবার।
![]() |
শহীদ আবদুল হাসিমের কবর |
মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯ এপ্রিল কোন কারণ ছাড়াই হাসিমকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল পাঞ্জাবিরা। এসময় উপায় না দেখে হাসিম স্মরণাপন্ন হন সেই নার্স সামার। তাকে কাকুতি মিনতি করে হাসিম বলেছিলেন, খালাম্মা আমার সম্পর্কে আপনি ভালো জানেন, আমি কেমন লোক তা আর কেউ না জানুক আপনি ভালো জানেন। আপনি আমাকে বাঁচান। তার এমন আকুতিতে নার্স সামা কর্ণপাততো করেইিনি উল্টো দাঁত কেলিয়ে বিশ্রীভাবে হেসেছিলেন বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা।
এরপর হাসিমকে পাঞ্জাবিরা ধরে নিয়ে বাসার অদুরে যায় এবং নির্মমভাবে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। স্বজন ও সহকর্মীরা তাকে হত্যার বিষয়টি দেখলেও সৈন্যদের ভয়ে কেউ কাছে ভীড়তে পারেনি সেদিন। এর তিনদিন পর সিআরবির সেনিটারি বিভাগের লোকজন খুজে পায় হাসিমের ক্ষতবিক্ষত মরদেহ। ততোদিনে শেয়াল আর কুকুর হাসিমের দেহ থেকে খাবলে খেয়ে নিয়েছে মাংস। সেনিটারি বিভাগের লোকজন ওই অবস্থাতেই হাসিমের হাড়গোর গর্ত করে পুতে রাখে। দেশ স্বাধীন হবার পর সেই হাড়গোর দাফন করে রেল কর্তৃপক্ষ।
এদিকে, দেশ স্বাধীন হবার পর অন্যরকম ভীতি পেয়ে বসে সেই বেঈমান নার্স সামাকে। প্রতিনিয়ত তার মনে হতো আশপাশের লোকজন তাকে হত্যা করবে। অনেকদিন আত্মগোপনে থাকার পর একদিন নিজেই গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করেন সামা।
আবদুল হাসিমের কবর কয়েকবছর আগেও যেনতেনভাবে পড়েছিল। তাঁর ছেলে মো. রফিক বর্তমানে রেলে কর্মরত। তাকে সেসময় বলেছিলাম, যে বাবার রক্তে বদলে তুমি সরকারি চাকরি পেয়েছো, তার কবর এভাবে পড়ে আছে, তোমার লজ্জা করে না ? এরপর যে অবস্থাতেই কবর ছিল সেটিকে পরিষ্কার রাখাসহ নানা চেষ্টা চালিয়েছে।
পরিশেষে বলি, এই সিআরবি পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে লুকিয়ে আছে বাঙালির নানা আন্দোলনের নানা ইতিহাস। আর সেই ইতিহাস কোন বেনিয়ার ইঙ্গিতে একদিনে শেষ হয়ে যাবে তা হতে পারেনা।
---আহসানুল কবির রিটন
স্টাফ করসপনডেন্ট, ইন্ডিপেনডেন্ট নিউজ
চট্টগ্রাম। ১৯ জুলাই ২০২১
কোন মন্তব্য নেই
please do not enter any spam link in the comment box.