Header Ads



শেরে মিল্লাত আল্লামা ওবাইদুল হক নঈমী

 

শেরে মিল্লাত আল্লামা ওবাইদুল হক নঈমী

এক কালজয়ী মনীষা

বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী ব্যক্তিত্ব, দেশের খ্যাতিমান শীর্ষ আলেমেদ্বীন, এশিয়াখ্যাত দ্বীনি প্রতিষ্ঠান, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া কামিল মাদরাসার শায়খুল হাদীস, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত বাংলাদেশের চেয়ারম্যান সিলসিলায়ে আলীয়া কাদেরীয়ার অন্যতম প্রচারক, আলা হযরত ফাউন্ডেশন বাংলাদেশর সম্মানিত উপদেষ্টা ওস্তাযুল ওলামা বাহরুল উলূম শেরে মিল্লাত আল্লামা মুফতি ওবাইদুল হক নঈমী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি গত ১৪ জিলক্বদ ১৪৪১ হিজরি ৬ জুলাই ২০২০ খ্রিস্টাব্দ সোমবার ৭৮ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজেউন। তাঁর ইন্তেকালে দেশ-বিদেশের সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে আসে। তিনি চিরন্তন বিধান হিসেবে আমাদের থেকে বিদায় নিলেও তাঁর আদর্শ ও মহিমাময় জীবনের স্মরণীয় অবদানগুলো প্রদীপ্ত সূর্যের ন্যায় দৃশ্যমান। তাঁর কর্মমূখর সফল পদচারণায় আলোকিত হয়েছে সুন্নীয়তের বিশাল অঙ্গন, এই প্রখ্যাত আলেমেদ্বীনের সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারনে এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।

জন্ম: তিনি বার আউলিয়ার স্মৃতি বিজড়িত চট্টগ্রাম জেলার অন্যতম প্রসিদ্ধ অলী হযরত মোহসেন আউলিয়ার স্মৃতিধন্য আনোয়ারা উপজেলায় চাঁপাতলী গ্রামে অলীয়ে কামেল হযরত ভোলা শাহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হির অধ:স্তন পুরুষ আলোকিত ব্যক্তিত্ব জনাব নুর আহমদ মুনশি আলকাদেরীর ঔরশেই ১৯৪৩ সনে বিশ্বজোড়া খ্যাতি সম্পন্ন আলেমেদ্বীন শেরে মিল্লাত আল্লামা মুফতি ওবাইদুল হক নঈমী জন্ম গ্রহণ করেন।

শিক্ষাজীবন

তাঁর শিক্ষাজীবন ছিল কৃতিত্বপূর্ণ। গ্রামের মক্তবেই তাঁর পড়ালেখার সূচনা। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম জেলার পাঁচলাইশ থানার ওয়াজেদীয়া আলীয়া মাদরাসায় ভর্তি হয়ে নিয়মতান্ত্রিক ভাবে দাখিল, আলিম, ফাযিল পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। এবং সরকারী বৃত্তি লাভ করেন। অত:পর হাদীস ও ফিকহ শাস্ত্রে বিশেষ ব্যুৎপত্তি অর্জনের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের গুজরাটের সর্বোচ্চ ধর্মীয় বিদ্যাপীট জামেয়া নঈমীয়া থেকে বিশ্ববরেণ্য আলেমেদ্বীন তাফসীরে নঈমী এর প্রণেতা হাকিমূল উম্মত আল্লামা মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর সান্নিধ্যলাভে ধন্য হয়ে কুরআন সুন্নাহ ও ফিকহশাস্ত্রে প্রজ্ঞা ও পান্ডিত্য অর্জন করেন। পূনরায় দেশে এসে ১৯৬৫ সনে ওয়াজেদীয়া আলীয়া মারদাসা হতে কামিল হাদীস সনদ অর্জন করেন। এবং পরবর্তী সনে ঢাকা সরকারী আলীয়া হতে কামিল ফিকহ সনদ লাভ করেন।

কর্ম জীবন

তিনি ছিলেন অসাধারণ প্রতিভাধর সফল শিক্ষক। তাঁর গোটা কর্মজীবন সাফল্যের ও গৌরবের। ওয়াজেদীয়া আলীয়া মাদরাসায় শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে তার কর্মজীবনের সূচনা। তথায় পূর্ণ একবৎসর শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৭ সনে তাঁরই শিক্ষাগুরু ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা গাজী আজিজুল হক শেরে বাংলা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হাটহাজারী আজিজিয়া অদুদিয়া সুন্নিয়া মাদরাসার প্রিন্সিপাল প্রখ্যাত আলেমেদ্বীন আল্লামা মুফতি ওকার উদ্দিন বেরলভী এর অনুরোধে সেই মাদরাসায় মুহাদ্দিস পদে কিছুদিন পাঠদান করেন। এর পরই ১৯৬৮ সনে তিনি ইমাম শেরে বাংলা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ও তাঁর শিক্ষাগুরু ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা নুরুল ইসলাম হাশেমী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র নির্দেশক্রমে তৎকালীন জামেয়ার প্রিন্সিপাল আল্লামা নসরুল্লাহ খান আফগানী বেরলভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র অনুরোধে কুতবুল আউলিয়া শায়খুল মাশায়েখ আল্লামা হাফেজ ক্বারী সৈয়দ আহমদ শাহ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়ায় যোগদান করেন। তখন থেকে ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত সুদীর্ঘ ৫২ বৎসর তিনি জামেয়ার মুহাদ্দিস পরবর্তীতে শায়খুল হাদীস পদে হাজার হাজার শিক্ষার্থীদের মাঝে ইলমে হাদীসের আলো বিতরণ করেন। একজন প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ হওয়ার পরও মুফতি হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল বিশ^জুড়ে। তবে মধ্যখানে তিনি দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান শাহ চাঁন্দ আউলিয়া মাদরাসা কর্তৃপক্ষের বিশেষ অনুরোধে ১৯৮০ সনে কামিল ক্লাশ চালু করার লক্ষ্যে এক বৎসর শায়খুল হাদীস হিসেবে দায়িত্ব পালন করে তিনি পূনরায় আপন পীর ও মুর্শিদ আওলাদে রসুল আল্লামা হাফেজ ক্বারী সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র নির্দেশক্রমে পূনরায় জামেয়ায় ফিরে আসেন।

জামেয়া,আনজুমান ও মাশায়েখ হযরাতে কেরামের খিদমত

তিনি ছিলেন চতুর্দশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ ইসলামী রেনেসাঁর মহান দিকপাল, জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় দেড় সহশ্রাধিক গ্রন্থ প্রণেতা আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’ অনুসৃত মসলকে আ’লা হযরতের এক অন্যতম মূখপাত্র। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র উপর ত্রিশপারা দরুদ শরীফের অদ্বিতীয় গ্রন্থ মজমুওয়ায়ে সালাওয়াতে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র প্রণেতা গাউসে জমান কুতুবে দাওরা খাজায়ে খাজেগান খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর প্রধান খলিফা কুতবুল আউলিয়া সৈয়্যদ আহমদ শাহ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া পরিচালনা পর্ষদের সাবেক শিক্ষক প্রতিনিধি। আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্টের অন্যতম সদস্য, জামেয়া শরীয়া বোর্ডের প্রধান মুফতি ছিলেন। একজন খ্যাতিমান আলেমেদ্বীন হওয়া সত্বেও তিনি রুহানিয়ত ও আধ্যাত্মিক পূর্ণতা অর্জনের জন্য ১৯৭৬ সনে আওলাদে রসূল গাউসে জমান আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র হাতে সিলসিলায়ে আলীয়া কাদেরীয়ায় বায়আত গ্রহণ করেন, তখন থেকে ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত তিনি হুযুর কেবলার মুখপাত্র হিসেবে তরীকত জগতে অনন্য খিদমত আন্জাম দিয়েছেন। জামেয়া, আনজুমান, গাউসিয়া কমিটি ও সিলসিলার প্রচার-প্রসারের কাজে মূখপাত্রের ভূমিকা পালন করেন। তাঁরই আহ্বানে দেশের হাজার হাজার শিক্ষার্থী ও আলেম ওলামা ও লক্ষ লক্ষ মুসলমান কাদেরীয়া তরীকায় অন্তর্ভূক্ত হন।

১৯৯৩ সনে তাঁর পীর ও মুর্শিদ ইন্তেকালের পরও বর্তমান দরবারের সাজ্জাদানশীন আওলাদে রসূল গাউসে জমান আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ (মু.জি.আ.) ও পীরে বাঙ্গাল আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ সাবের শাহ (মু.জি.আ.)র সান্নিধ্য থেকে তিনি এক মূহুর্তের জন্যও পিছপা হননি। মাশায়েখ হযরাতে কেরামের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালবাসা ছিল নিরেট নিখাদ।

সাংগঠনিক জীবন

তিনি ছিলেন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত বাংলাদেশের চেয়ারম্যান। দেশ ব্যাপী সুন্নী মুসলমানদের ঐক্য সৃষ্টিতে তাঁর অবদান ছিল অনন্য। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র সেনার প্রতিষ্ঠাতা পৃষ্ঠপোষক, সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় সুন্নীয়ত প্রতিষ্ঠায় একমাত্র রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের সাবেক প্রেসিডিয়াম বোর্ড মেম্বার। আহলে সুন্নাত সম্মেলন সংস্থা (ওএসি)র অন্যতম উপদেষ্টা। আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র জীবন ও কর্মের গবেষণা বিষয়ক প্রতিষ্ঠান আ’লা হযরত ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ’র উপদেষ্টা। ১৯৭১ সনে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ইসলাম নামধারী মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা বিরোধীদের স্বরূপ উন্মোচনে তাঁর শিক্ষাগুরু ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা নুরুল ইসলাম হাশেমীর সাথে একাকার হয়ে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন।

সফর ও যিয়ারত

তিনি জীবনে অসংখ্যবার হারামাঈন শরীফাইনে হজ¦ব্রত ও যিয়ারতে মুস্তাফায় গমন করেন। এ ছাড়াও বায়তুল মোকাদ্দাস শরীফ, বাগদাদ শরীফ, আজমীর শরীফ, সিরিকোট শরীফ, চৌহর শরীফ, বেরেলী শরীফসহ পৃথিবীর দেশে দেশে অসংখ্য নবী রসূল, সাহাবায়ে কেরাম ও আউলিয়ায়ে কেরামের যিয়ারতে গমন করেন। দেশ বিদেশের অসংখ্য আন্তর্জাতিক ইসলামি কনফারেন্স, সভা, সমাবেশ, সেমিনার, সিম্পোজিয়ামে তিনি অংশগ্রহণ করে মূল্যবান বক্তব্য উপস্থাপন করেন। তিনি ওয়ার্ল্ড ইসলামিক মিশন লন্ডন’র অন্যতম সদস্য ছিলেন। তিনি সৌদি আরব, ভারত, পাকিস্তান, রেঙ্গুন, মায়ানমার, মালয়েশিয়া, তুরস্ক, নেপাল, লন্ডন, ওমান, কাতার, প্যালেস্টাইন ইত্যাদি রাষ্ট্র সফর করেন। ২০০০ সনে ১ ও ২ এপ্রিল পাকিস্তানের মুলতান স্টেডিয়ামে ২দিন ব্যাপী অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল সুন্নী কনফারেন্সে তিনি বিশেষ মেহমান হিসেবে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। জামেয়ার সাবেক অধ্যক্ষ খতীবে বাঙ্গাল আল্লামা জালাল উদ্দিন আলকাদেরী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ও বিশেষ মেহমান হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন। আমিও সেই কনফারেন্সে আ’লা হযরত ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ’র পক্ষ থেকে প্রতিনিধিত্ব করেছিলাম।

লেখালেখি ও গ্র্রন্থ রচনা

তিনি আরবি, উর্দু, ফার্সী ও বাংলা ভাষায় সমান পারদর্শি ছিলেন, উর্দু ও বাংলা ভাষায় তাঁর অসংখ্য প্রবন্ধ, নিবন্ধ, মাসিক তরজুমানে আহলে সুন্নাত, মাসিক জীবন বাতি, মাসিক জ্ঞানের আলো, মদিনার পথে, আল মুখতার, রাহমাতুল্লীল আলামীন ইত্যাদি প্রকাশনায় তাঁর অসংখ্য প্রবন্ধ, নিবন্ধ, অভিমত ও ফাতওয়া প্রকাশিত হয়। মিলাদ-কিয়াম ও দরুদ সালাম’র বৈধতার উপর তাঁর প্রামাণ্য গ্রন্থ দালায়েলুল কিয়াম লেমিলাদে খায়রিল আনাম” তাঁর অনবদ্য রচনা।

অধ্যক্ষ মুহাম্মদ বদিউল আলম রেজভী

কোন মন্তব্য নেই

please do not enter any spam link in the comment box.

merrymoonmary থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.