ইসলামের দৃষ্টিতে ধর্ষণ ও ব্যভিচার সুস্পষ্ট হারাম।
ব্যভিচারী ও ধর্ষক উভয়ের জন্যই কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করেছে ইসলাম।
ধর্ষণ নিকৃষ্ট ও জঘন্য কাজ। এর জন্য ইহকালে ও পরকালে
কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। ইসলাম ধর্ষণকে ভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেনি। বরং
বিবাহবহির্ভূত যেকোনো যৌন সম্পর্কই ইসলামে অপরাধ হিসেবে গণ্য। ফলে ব্যভিচারী ও
ধর্ষক উভয়ের জন্যই কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করেছে ইসলাম। ইসলামি আইনশাস্ত্র মোতাবেক
ধর্ষকের শাস্তি ব্যভিচারকারীর শাস্তির অনুরূপ। তবে অনেক ইসলামি আইনজ্ঞরা ধর্ষণের
ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কিছু শাস্তির কথা উল্লেখ করেছেন।
ব্যভিচারের মন্দ পরিণাম ছয়টি। তিনটি দুনিয়ায় আর তিনটি
আখিরাতে। দুনিয়ার তিনটি হলো—১. চেহারার সৌন্দর্য নষ্ট হওয়া, ২. দরিদ্রতা, ৩.
অকালমৃত্যু। আর আখিরাতের তিনটি হলো—১. আল্লাহর অসন্তুষ্টি, ২. হিসাব-নিকাশের
কঠোরতা ও ৩. জাহান্নামের কঠিন শাস্তি।
ধর্ষণ ও ব্যভিচার সুস্পষ্ট হারাম
শিরক ও হত্যার পর ব্যভিচার সুস্পষ্ট হারাম ও বড় ধরনের
অপরাধ। কোরআনে কারিমে বলা হয়েছে,
وَ لَا تَقۡرَبُوا الزِّنٰۤی اِنَّہٗ کَانَ فَاحِشَۃً ؕ وَ سَآءَ سَبِیۡلًا
আর তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেও না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ।’ (সুরা আল ইসরা, আয়াত : ৩২) প্রখ্যাত তাফসিরবিশারদ ইমাম কুরতুবি (রহ.) বলেন, “উলামায়ে কেরাম বলেছেন, ‘ব্যভিচার করো না’-এর চেয়ে ‘ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না’ এটি অনেক বেশি কঠোর কথা।” এর সহজ অর্থ হলো, যেসব বিষয় ব্যভিচারে উদ্বুদ্ধ করে ও ভূমিকা রাখে সেগুলোও হারাম।
ধর্ষকের শাস্তি
ধর্ষণের ক্ষেত্রে এক পক্ষ থেকে ব্যভিচার সংঘটিত হয়। আর
অন্য পক্ষ হয় মজলুম বা নির্যাতিত। তাই মজলুমের কোনো শাস্তি নেই। শুধু জালিম বা
ধর্ষকের শাস্তি হবে। ধর্ষণের ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় সংঘটিত হয়। এক. ব্যভিচার। দুই.
বল প্রয়োগ। তিন. সম্ভ্রম লুণ্ঠন। ব্যভিচারের জন্য কোরআনে বর্ণিত ব্যভিচারের শাস্তি
পাবে। ইসলামে ব্যভিচারের শাস্তি ব্যক্তিভেদে একটু ভিন্ন। ব্যভিচারী যদি বিবাহিত
হয়, তাহলে তাকে প্রকাশ্যে পাথর মেরে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। আর যদি অবিবাহিত হয়,
তাহলে তাকে প্রকাশ্যে ১০০ বেত্রাঘাত করা হবে। হানাফি, শাফেয়ি ও হাম্বলি মাজহাব
মতে, ধর্ষণের জন্য ব্যভিচারের শাস্তি প্রযোজ্য হবে। তবে ইমাম মালেক (রহ.)-এর মতে,
ধর্ষণের অপরাধে ব্যভিচারের শাস্তির পাশাপাশি ‘মুহারাবা’র শাস্তি প্রয়োগ করা হবে।
‘মুহারাবা’ হলো অস্ত্র দেখিয়ে বা অস্ত্র ছাড়াই ভীতি প্রদর্শন করে ডাকাতি করা কিংবা
লুণ্ঠন করা। এককথায় ‘মুহারাবা’ হলো পৃথিবীতে অনাচার সৃষ্টি, লুণ্ঠন, নিরাপত্তা
বিঘ্নিতকরণ, ত্রাসের রাজ্য কায়েম করা ইত্যাদি। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ
‘মুহারাবা’র শাস্তি এভাবে নির্ধারণ করেছেন,
اِنَّمَا جَزٰٓؤُا الَّذِیۡنَ یُحَارِبُوۡنَ اللّٰہَ وَ رَسُوۡلَہٗ وَ یَسۡعَوۡنَ فِی الۡاَرۡضِ فَسَادًا اَنۡ یُّقَتَّلُوۡۤا اَوۡ یُصَلَّبُوۡۤا اَوۡ تُقَطَّعَ اَیۡدِیۡہِمۡ وَ اَرۡجُلُہُمۡ مِّنۡ خِلَافٍ اَوۡ یُنۡفَوۡا مِنَ الۡاَرۡضِ ؕ ذٰلِکَ لَہُمۡ خِزۡیٌ فِی الدُّنۡیَا وَ لَہُمۡ فِی الۡاٰخِرَۃِ عَذَابٌ عَظِیۡمٌ
যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং
দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কাজ করে বেড়ায়, তাদের শাস্তি হচ্ছে : তাদের হত্যা করা হবে অথবা
শূলে চড়ানো হবে বা তাদের হাত-পা বিপরীত দিক থেকে কেটে দেওয়া হবে কিংবা দেশ থেকে
নির্বাসিত করা হবে। এটি তাদের পার্থিব লাঞ্ছনা, আর পরকালে তাদের জন্য রয়েছে কঠিন
শাস্তি।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৩৩)
বিবাহিত ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণীকে আমৃত্যু পাথর নিক্ষেপ
করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ শরিয়তে ব্যভিচারী বিবাহিত হলে তার শাস্তি রজম বা
পাথর নিক্ষেপে মৃত্যুদণ্ড। আর অবিবাহিত ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণীকে ১০০ বেত্রাঘাত
করা হবে। কোরআনে বলা হয়েছে,
اَلزَّانِیَۃُ وَ الزَّانِیۡ فَاجۡلِدُوۡا کُلَّ وَاحِدٍ مِّنۡہُمَا مِائَۃَ جَلۡدَۃٍ ۪ وَّ لَا تَاۡخُذۡکُمۡ بِہِمَا رَاۡفَۃٌ فِیۡ دِیۡنِ اللّٰہِ اِنۡ کُنۡتُمۡ تُؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰہِ وَ الۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ ۚ وَ لۡیَشۡہَدۡ عَذَابَہُمَا طَآئِفَۃٌ مِّنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ
ব্যভিচারিণী ও ব্যভিচারী তাদের প্রত্যেককে একশত করে
বেত্রাঘাত কর। আল্লাহর আইন কার্যকর করার ব্যাপারে তাদের প্রতি দয়ামায়া তোমাদেরকে
যেন প্রভাবিত না করে, যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাত দিনের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে
থাক। একদল মু’মিন যেন তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে। (সুরা নুর, আয়াত : ২)
ধর্ষককে হত্যা করলে বা ধর্ষিতার মৃত হলে
হজরত সাঈদ ইবনে জায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমি
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘সম্পদ রক্ষা করতে
গিয়ে যে ব্যক্তি নিহত হয়েছে, সে শহিদ। জীবন রক্ষা করতে গিয়ে যে নিহত হয়েছে, সে
শহিদ। দ্বীন রক্ষা করতে গিয়ে যে নিহত হয়েছে, সেও শহীদ। আর সম্ভ্রম রক্ষা করতে গিয়ে
যে নিহত হয়েছে, সেও শহিদ।’ (আবু দাউদ, তিরমিজি)
হাদিসের আলোকে বুঝা যায়, যদি কোনো ব্যক্তি নিজের সম্ভ্রম
বাঁচাতে গিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে আর সে প্রতিরোধে হত্যার মতো কোনো ঘটনা ঘটে তাতেও
কোনো দোষ নেই। কেননা সম্ভ্রম বাঁচাতে গিয়ে যদি প্রতিরোধকারী নিহত হয় তবে সে পাবে
শাহাদাতের মর্যাদা। এ প্রতিরোধে সম্ভ্রম লুণ্ঠনকারীও নিহত হতে পারে।
ধর্ষণের শিকার হলে আত্মহত্যা করা কি বৈধ?
শুধু ধর্ষণের শিকার হলে নয় যে কোন কারণে আত্মহত্যা করা
ইসলামের দৃষ্টিতে সর্বাবস্থায় আত্মহত্যা করা হারাম বা নিষিদ্ধ।
সমাজে ধর্ষণের শিকার হওয়া ব্যক্তিকে বাঁকা চোখে দেখে।
তার প্রতি অবহেলা ও নানান কটুক্তি করে থাকে মানুষ। যা কোনোভাবে কাম্য নয়। কেননা
ধর্ষনের শিকার হওয়া ব্যক্তি বল প্রয়াগকারী বা ক্ষমতাধর ব্যক্তির অত্যাচারের শিকার।
ইসলামের আলোকে এ ব্যক্তি মাজলুম।
তাই যে ব্যক্তি ধর্ষণের শিকার হয়েছে, তাকে ধর্ষণ হওয়ার
কারণে যেমন অপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত করা যাবে না তেমনি তাকে বাঁকা চোখে দেখা কিংবা
কটুক্তিও করা যাবে না।
আত্মহত্যা যে কারণেই করা হোক; ইসলাম কোনোভাবেই কোনো
আত্মহত্যাকেই সমর্থন করে না। সর্বাবস্থায় আত্মহত্যা করা হারাম বা নিষিদ্ধ।
কোনো নারীকে যদি জোরপূর্বক ধর্ষণ করা হয়, তবে ইসলামের
পরিভাষায় সে নারী মাজলুম তথা অত্যাচারিত। এ জোরপূর্বক ধর্ষণের ফলে ওই নারীর যেমন
কোনো গোনাহ হয় না বরং নির্যাতিত নারীর মর্যাদা আল্লাহর দরবারে অনেকগুণ বেড়ে যায়।
যেখানে জোরপূর্বক ধর্ষণের শিকার নারীর কোনো গোনাহ হয় না
এবং নির্যাতিত মজলুম নারীর মর্যাদা আল্লাহ বৃদ্ধি করে দেন এবং তার দোয়া কবুল করে
নেন, সেখানে ওই নারীর জন্য আত্মহত্যা কিভাবে বৈধ হতে পারে?
কোন মন্তব্য নেই
please do not enter any spam link in the comment box.