হাইব্রিড মানেই হাইব্রিড - মোস্তফা কামাল পাশা
দুর্নীতির ‘দু’ আর ‘রেফ’টা ছাটাই করে দিই চাপাতির কোপে। দুর্নীতি হয়ে যায় নীতি। এটাই হাইব্রিড রাজনীতিতে টিকে থাকার প্রধান অস্ত্র।
সরীসৃপটা বেরিয়ে পড়ে। ব্যাঙ্কের হাজার হাজার কোটি টাকা বেমালুম গায়েব করে দিই। পেশিশক্তির জোরে সমস্ত বৈষয়িক সম্পদের মালিকানা জবরদস্তি নিজের দখলে নিই। রাজনৈতিক প্রভাবের ছাতা ধরে দুর্নীতির ‘দু’ আর ‘রেফ’টা ছাটাই করে দিই চাপাতির কোপে। দুর্নীতি হয়ে যায় নীতি। এটাই হাইব্রিড রাজনীতিতে টিকে থাকার প্রধান অস্ত্র।
বিদায়ী বছরে আলোচিত কয়েকটি নতুন শব্দের মধ্যে হাইব্রিড শব্দটি রাজনীতিতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তুখোড় রাজনীতিক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের শব্দটি চালু করেন। জনাব কাদের, ছাত্রলীগের সভাপতির পদের পাশাপাশি মূল দলের বিভিন্ন স্তরে দায়িত্বশীল পদে ছিলেন। পেশাগত জীবনে তিনি সাংবাদিকতায়ও জড়িত ছিলেন। অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলার বাণীর সহকারি সম্পাদক হিসাবে নিয়মিত রাজনৈতিক কলাম লিখতেন। রাজনৈতিক কলামগুলোর মতো রাজনৈতিক বক্তব্যেও তার বলার ধরণ ও শব্দচয়ন কিছুটা অলঙ্কারিক।
বক্তব্যের পরিবেশনা শৈলীতেও তিনি নিজস্ব একটি স্টাইল তৈরি করেছেন। টাঙ্গাইলের বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকীর তৈরি টাঙ্গাইলের দুর্ধর্ষ মুক্তিবাহিনী ইতিহাসের পৃষ্ঠায় কাদেরিয়া বাহিনী নামে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে। ওবায়দুল কাদেরের বাচনভঙ্গিও ‘কাদেরিয়া স্টাইল’ নামে ভবিষ্যতে জনপ্রিয়তা পেতেই পারে। আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর কিছু অত্যুৎসাহী নব্য নেতা-কর্মীর বাড়াবাড়িতে ত্যাক্ত-বিরক্ত হয়ে তিনি বলেছেন, দলে হাইব্রিড নেতার উৎপাত বেড়ে গেছে। দল ক্ষমতায় থাকলে এরা মৌমাছির মত ভিড় করে। কিন্তু দলের বিপদের সময় হাইব্রিডওয়ালাদের হারিকেন নিয়েও খুঁজে পাওয়া যায় না। তিনি হাইব্রিড রাজনীতিকদের ব্যাপারে দলের নিবেদিত ও ত্যাগী নেতা কর্মীদের অনেকবার সতর্ক করে দিয়েছেন। ছাত্র রাজনীতির সিঁড়ি ভেঙ্গে রাজনীতির মূল আঙিনায় উঠে এসেছেন ওবায়দুল কাদের।
দলের দুর্দিনে-সুদিনে সব সময় সামনের সারিতে থেকে দায়িত্ব পালন করেছেন। স্বাভাবিক কারণে পোড়খাওয়া নেতা হিসাবে আওয়ামী রাজনীতির ভেজাল ও খাঁটি চেনার মত প্রজ্ঞা তাঁর আছে। তার বাচনভঙ্গি ও শব্দচয়নে আলঙ্কারিক প্রভাব যেমন আছে, তেমনি আছে তীক্ষ্ম হূলের খোঁচা। তো, হুলের মত বিপজ্জনক কোন বস্তু নিয়ে নাড়াচাড়া করার দরকার নেই। বরং হাইব্রিড শব্দটির শানেনযূল চর্চা করা যাক। রাজনীতিতে হাইব্রিড শব্দটি নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী, পন্ডিত এবং বিশ্লেষক-বিশেষজ্ঞরা প্রচুর শব্দ খরচ করেছেন ধারাবাহিকভাবে। টিভি চ্যানেলের চারশো-পাঁচশো পর্বের সিরিয়ালের মতো তা চলমান আছে। বাস্তবে হাইব্রিড নিয়ে এত শব্দচর্চা একেবারেই অনর্থক।
অনর্থক শব্দ খরচ না করে আসা যাক মূল প্রসঙ্গে। কর্পোরেট অর্থনীতির ইঞ্জিনটা ঘুরছে হাইব্রিড টেকনোলজির উপর ভর করে। এটা জানতে আপনাকে পেশাদার কর্পোরেট নির্বাহী বা ম্যানেজমেন্ট এক্সপার্ট হতে হবে না। সকালের নাস্তার টেবিলেই পেয়ে যাচ্ছেন সব প্রমাণ। গমের তৈরি রুটি, পাউরুটি, পরোটা যাই খান না কেন, এটা কিন্তু হাইব্রিড। অর্থাৎ রুটি, পাউরুটি বা পরোটার মূল শস্য ‘গমগুলো’ জাতে হাইব্রিড বাংলায় উচ্চ ফলনশীল। যে ওমলেট, পোচ বা ডিম সেদ্ধ খাচ্ছেন সেটাও হাইব্রিড ফার্মের মুরগির। সব্জির আইটেমে যে সব উপাদান আছে অর্থাৎ আলু, গাজর, ফুলকপি, বাঁধাকপি, সিম, পটল, মূলা এমনকি লেবু বা কাঁচা লঙ্কাটিও হাইব্রিড। চিকেন কোনো আইটেম থাকলে তাও হাইব্রিড-ফার্মের মুরগি। গেল সকালের নাস্তা। দুপুরের খাবারে পুষ্টিবিদের তালিকা ধরে যে ক’কাপ ভাত খাচ্ছেন তাও হাইব্রিড চালের।
রুই-কাতল, মৃগেল, কই যে মাছই খান তাও হাইব্রিড। মিষ্টি যদি খাবার তালিকা থেকে ছাটাই না হয়, তাহলে মিষ্টিটাও কিন্তু হাইব্রিড। দুধটা হাইব্রিড গাভির। দুধের ভেজালও হাইব্রিড গম, চাল বা ওয়াসার পানির মত হাইব্রিড প্রজাতির উপাদান থেকে এসেছে। রাতের খাবারও আপনার সাথে আবশ্যিকভাবে হাইব্রিডের দেখা হয়ে যাবে। এক কথায় আমাদের জীবনের চাকা ঘুরছে হাইব্রিড জ্বালানির উপর ভর করে। তাহলে আপনি কোন মুখে হাইব্রিডকে দুষবেন? হাইব্রিড খাবারের উপর বেঁচে আছেন আপনি এবং আপনার পরিবার। হাইব্রিড খেয়ে বেঁচে থাকব, ভাষণ, টকশো, বক্তৃতা, বিবৃতি ঝাড়বো হাইব্রিডের বিরুদ্ধে! এরচে’ অন্যায় অবিচার আর কী হতে পারে?
খাল-বিল-পুকুর-নালা, ফসলের মাঠ, পশু-পাখির খামার থেকে অন্দরের কিচেন, ডাইনিং পর্যন্ত হাইব্রিডেল দখলে গেলে রাজনীতিতে সনাতন ধারা চলবে কোন যুক্তিতে? হাইব্রিড, ধান, গম, সবজি, ফল, মাছ-মাংস উৎপাদিত না হলে আমাদের দেশ কী কখনো খাদ্যে স্বয়ম্ভর হতে পারতো? ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল এক চিলতে ছোট্ট ভূখণ্ডে খালবিল, ঝিল, বন, নদী-নালাসহ ষোল কোটি মানুষ খেয়ে পরে কী বেঁচে থাকতে পারতো? উত্তর হচ্ছে, পারতো না। তাই হাইব্রিড সভ্যতাকে মানতেই হবে। রাজনীতিতেও হাইব্রিড কালচারকে জায়গা করে দিতে হবে। হাইব্রিড বলে উঠতি ভাগ্যশিকারি রাজনীতি বণিকদের গালাগালি করা চলবে না। হাইব্রিড সভ্যতায় বাস করে, হাইব্রিডকে অস্বীকার করার অপর নাম ‘বেঈমানি’।
অবশ্য হাইব্রিড সভ্যতা, আমাদের বহিরাঙ্গে ইমানদার বা সত্যের চটকদার পোশাক এবং লোগো ঝুলিয়ে দিলেও ভেতরটায় পুষে রেখেছি মিথ্যা ও বেইমানির ভয়ঙ্কর সরীসৃপ। যেখানেই স্বার্থ, লাভের গুড় সেখানেই সত্যের খোলস থেকে কিলবিল করে অক্টোপাসের বাহুর মত কিলবিল করে লোভের সরীসৃপটা বেরিয়ে পড়ে। ব্যাঙ্কের হাজার হাজার কোটি টাকা বেমালুম গায়েব করে দিই। পেশিশক্তির জোরে সমস্ত বৈষয়িক সম্পদের মালিকানা জবরদস্তি নিজের দখলে নিই। রাজনৈতিক প্রভাবের ছাতা ধরে দুর্নীতির ‘দু’ আর ‘রেফ’টা ছাটাই করে দিই চাপাতির কোপে। দুর্নীতি হয়ে যায় নীতি। এটাই হাইব্রিড রাজনীতিতে টিকে থাকার প্রধান অস্ত্র।
হ্যাঁ এটা সত্য, রাজনীতি হচ্ছে, দেশ-জাতি সভ্যতার ইঞ্জিন। মিশনারি মনোভাব না থাকলে, ত্যাগের মত বড় গুণ না থাকলে রাজনীতি করা যায় না। মানুষের ভোগ্য উপাদানগুলো হাইব্রিড হলেও মানুষ হাইব্রিড প্রাণি নয়। মানুষের ক্লোন তৈরি করা গেলেও হাইব্রিড মানুষ এখনো তৈরি হয়নি। তাই তাকে নীতি-নৈতিকতা, মানবিকতা, মেধা-মনন-জ্ঞানে পরিপুষ্ট হতে হয়। এসব গুণাবলী ছাড়া কোনো মানুষ প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠতে পারে না। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, এই প্রজাতির মানুষ দ্রুত বিলুপ্তির পথে। দু’একজন বেঁচে থাকলেও তারা ‘আহাম্মক’ শব্দের লোগোর পর্দার আড়ালে। তাই রাজনীতিতে হাইব্রিডওয়ালাদের দাপট বাড়ছেই। এই প্রাদুর্ভাব থামানোর কোন যাদুই কাঠি ওবায়দুল কাদের সাহেবদের হাতে নেই। নতুন বছরে আমাদের প্রার্থনা হোক, আমরা ত্যাগের মন্ত্রে দীক্ষিত হবো- ‘ভোগের দানব রুখবোই’। অবশ্য এই ত্যাগ হচ্ছে, শরীরের বর্জ্য ত্যাগ আর ভোগের দানব হচ্ছে, যা নিজে হজম করতে পারি না, তা অন্যকেও হজম করতে কখনো দেব না!
মোস্তফা কামাল পাশা
কোন মন্তব্য নেই
please do not enter any spam link in the comment box.