আজ জননেতা আক্তারুজ্জামান চৌধুরী বাবু মৃত্যুবার্ষিকী।
বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ'র সভাপতিমন্ডলীর সাবেক সদস্য জননেতা আক্তারুজ্জামান চৌধুরী বাবু মৃত্যুবার্ষিকী।
আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ছিলেন বনেদি ও ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান ও একজন দেশবরেণ্য শিল্পপতি। দেশের ব্যবসায়ী সংগঠনের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করার পরও নিজেকে একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন না; দেশ ও মানুষকে ভালোবাসতেন বিধায় তিনি একজন রাজনীতিক হিসেবে পরিচয় দিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। তার কর্মময় জীবনের ব্যাপ্তি ছিল বিশাল।
বিশাল হৃদয়ের অধিকারী এ জননেতা সব মানুষের বিপদ-আপদে দরদি হৃদয় নিয়ে এগিয়ে আসতেন, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। দলের দুঃসময়ে প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে তার সরব উপস্থিতি নেতাকর্মীদের মাঝে প্রাণসঞ্চার করত। দলের দুর্দিনে তিনি কখনও নির্লিপ্ত থাকেননি। বৃহত্তর চট্টগ্রামের আওয়ামী রাজনীতির অভিভাবক আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর স্মৃতি চিরঞ্জীব হয়ে থাকবে।
আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু চট্টগ্রামের খ্যাতিমান রাজনীতিক ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। নানা ঝড়-ঝাপটার মধ্যেও দলীয় আদর্শে তিনি ছিলেন অবিচল; দলীয় নেতাকর্মীদের কাছে হয়ে উঠেছিলেন বড় অবলম্বন।
কেবল রাজনীতি নয়, ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পায়নের মাধ্যমেও দেশের মানুষের জন্য কাজ করেছেন তিনি। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে বেকারত্ব হ্রাসে সহায়তা করেছেন। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন চারবার। নবম জাতীয় সংসদে তিনি ছিলেন পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি।
আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। ১৯৬৭ সালে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। ’৭০ সালের নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হন। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। স্থানীয় সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্ব দেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা চট্টগ্রামে আসার পর জুপিটার হাউস থেকে সাইকোস্টাইল করে প্রচার করা হয়। তার বাসা থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রসহ সব জায়গায় পাঠানো হয়। তিনি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অধীনে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া তিনি মুজিবনগর সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটির সদস্য ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি তিনি বিশ্বজনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চল সফর করেন। তিনি প্রথমে লন্ডনে যান। সেখান থেকে ১৯৪৫ সালে আনোয়ারা হাইলধর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। তার পিতার নাম নূরুজ্জামান চৌধুরী। তিনি ছিলেন আইনজীবী এবং জমিদার। তার মাতার নাম খোরশেদা বেগম। শিল্পপতি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর দ্বিতীয় কন্যা নূর নাহার জামান তার সহধর্মিণী। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ১৯৫৮ সালে ম্যাট্রিক পাসের পর ঢাকা নটর ডেম কলেজে ভর্তি হন।
ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময় তিনি বৃত্তি পেয়ে আমেরিকার ইলিনয় ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে ভর্তি হন। পরে তিনি নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে পড়াশোনা করেন। সেখান থেকে অ্যাসোসিয়েট ডিগ্রি নিয়ে ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরে দেশে ফিরে ব্যবসা শুরু করেন।
আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ছিলেন আপাদমস্তক একজন দেশপ্রেমিক। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার পথে তিনি ছিলেন একজন সুদক্ষ কর্মী। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জননেত্রী শেখ হাসিনার সোনার বাংলা বিনির্মাণ ছিল তার একমাত্র লক্ষ্য।বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে আমেরিকায় যান। ১৯৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য (এমপিএ) হিসেবে আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ১৯৭২ সালে গঠিত বাংলাদেশ গণপরিষদের সদস্য হন এবং বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে ভূমিকা রাখেন।
১৯৮৬, ১৯৯১ এবং ২০০৮ সালে তিনি জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। স্বাধীনতার পর তিনি দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন এবং দল পুনর্গঠনে সাহসী ভূমিকা পালন করেন।
স্বৈরাচারবিরোধী বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন এবং কারা নির্যাতন ভোগ করেন। শিল্পপতি বাবু স্বাধীনতার আগে বাটালি রোডে বয়েল ইন্ডাস্ট্রি নামে একটি কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন।
পরবর্তীকালে আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু আসিফ স্টিল মিল, জাভেদ স্টিল মিল, আসিফ সিনথেটিক, প্যানআম বনস্পতি, আফরোজা অয়েল মিল, বেঙ্গল সিনথেটিক প্রোডাক্ট ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ভ্যানগার্ড স্টিল মিল, সিনথেটিক রেজিন প্রোডাক্ট ক্রয় করে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের প্রথম দু’দশকে জামান শিল্পগোষ্ঠীর গোড়াপত্তন করেন।
তিনি আরামিট মিল ক্রয় করে সেটিকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করান। তিনি দেশে দ্বিতীয় প্রাইভেট ব্যাংকের (ইউসিবিএল) উদ্যোক্তা এবং প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। তিনি দু’দফায় চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রেসিডেন্ট ছাড়াও ১৯৮৮ সালে এফবিসিসিআইয়ের প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
ওআইসিভুক্ত দেশগুলোর চেম্বারের প্রেসিডেন্ট হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৯ সালে তিনি ৭৭ জাতি গ্র“পের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনিই একমাত্র বাংলাদেশি, যিনি এ মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থার ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন।
ব্যক্তিজীবনে আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ছিলেন ৩ ছেলে ও ৩ কন্যাসন্তানের জনক। ১৯৬৭ থেকে ’৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি হাইলধর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও থানা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন।
চট্টগ্রামের আনোয়ারা এবং পশ্চিম পটিয়ার বহু মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর রাজনৈতিক জীবনের পাশাপাশি পারিবারিক ও সমাজ জীবনও ছিল সুশৃঙ্খল ও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। সামাজিক ও ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে তার বিচরণ ছিল রাজনীতির ঊর্ধ্বে এবং রাজনৈতিক ভেদাভেদের সীমারেখার ঊর্ধ্বে।
তার ব্রত ছিল মানবতাবোধে উদ্দীপ্ত। তার কাছে রাজনীতি ছিল বৃহত্তর মানবকল্যাণের মাধ্যম। মমত্ববোধ, মৈত্রী ও সমঝোতার অন্বেষণে তার প্রয়াস ছিল অক্লান্ত। সাংঘর্ষিক ও সহিংস রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ছিল দৃঢ় অথচ নম্র ও শান্ত। তিনি বনেদি ও ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান এবং দেশের স্বনামধন্য শিল্পপতি হয়েও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পতাকাকে সমুন্নত রাখতে সাধারণ মানুষের রাজনীতিতে আমৃত্যু সম্পৃক্ত ছিলেন।
তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই; তবুও তিনি আমাদের অন্তরে চির জাগ্রত। আজ আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি তার স্মৃতি, অর্থপূর্ণ জীবন ও লালিত মূল্যবোধ। তার আদর্শ অন্তরে ধারণ করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি আধুনিক ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমাদের পথ চলতে হবে। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর মতো ত্যাগী নেতার আজ বড় প্রয়োজন।
আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর সঞ্চয় ছিল সাধারণ মানুষের ভালোবাসা। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লোভ ও লালসার ঊর্ধ্বে থেকে গণমানুষের জন্য কাজ করে গেছেন তিনি।
সেবার দ্বারা ও মহৎ কর্মের মাধ্যমে আলোর প্রদীপ হাতে নিয়ে যে মানুষটি অবদান রেখেছিলেন সংগ্রাম-আন্দোলনে, সে মানুষটি আজ তার নিজ গ্রামে চিরনিদ্রায় শায়িত। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু প্রমাণ করেছেন- মানুষকে ভালোবাসলে তাদের জন্য কাজ করলে মানুষ তার প্রতিদান দেয়। তাই তো মরেও বেঁচে আছেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু।
২০১২ সালের ৪ নভেম্বর তিনি ইন্তেকাল করেন। তার মৃত্যুতে আওয়ামী পরিবারে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তা কখনও পূরণ হওয়ার নয়।
কোন মন্তব্য নেই
please do not enter any spam link in the comment box.